দেশের স্বাস্থ্য খাতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী চিকিৎসক কর্মকর্তার ব্যানারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লাগাতার ঘেরাও, মৌন মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চলছে। তাদের মারমুখী স্লোগান ও আচরণে আতঙ্কিত হয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও অধিদপ্তরে অনুপস্থিত থাকছেন। সরকার পরিবর্তনের পর ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের দুটি বিপরীতমুখী আদেশ জারি হওয়ায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মরত কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা দাবি আদায়ে ঢাকায় আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমঅ্যান্ডডিসি) মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টদের নিবন্ধন দিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে শুরু থেকেই এ খাতে অস্থিরতা চলছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিপ্তরের দুই অতিরিক্ত মহাপরিচালককে ওএসডি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিপ্তরের দুই অতিরিক্ত মহাপরিচালকের জায়গায় আর কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নতুন একজন মহাপরিচালক নিয়োগ করা হলেও তিনি এখন পর্যন্ত অফিস করতে পারেননি। অন্যদিকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রশাসন এবং পরিচালক প্রশাসন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অথচ এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা লক্ষণীয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যান্য উপদেষ্টার মতো স্বাস্থ্য উপদেষ্টার তৎপরতা লক্ষণীয় নয়। এ ক্ষেত্রে দ্রুত স্বাস্থ্যবিষয়ক কমিশন করে দেশের স্বাস্থ্য বা জনগণের স্বাস্থ্য নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মক বিঘ্নিত হবে, এমনকি স্বাভাবিক সেবাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নবনিযুক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, এ মুহূর্তে এত কিছুর দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ নেই। এখন আহত শিক্ষার্থীদের সুস্থতাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে। তারপর অন্য বিষয়ে নজর দেওয়া যাবে।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টরা বিএমডিসি থেকে নিবন্ধন নিয়ে নেয়। এতে এমবিবিএস ও বিডিএস চিকিৎসকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এর প্রতিবাদে এমবিবিএস ও বিডিএস চিকিৎসকরা আজ বুধবার সকাল ১০টায় লং মার্চ টু বিএমডিসি কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএমঅ্যান্ডডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, আইন অনুযায়ী কোনো মেডিকেল প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তিন বছরের কম নয় এরূপ সময়ব্যাপী মেডিকেল চিকিৎসা প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর ওই মেডিকেলে চিকিৎসা ডিপ্লোমাধারী মেডিকেল সহকারীরা এই আইনের অধীনে কাউন্সিল কর্তৃক নিবন্ধন হওয়ার যোগ্য। তবে ন্যূনতম এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রিপ্রাপ্তরা ছাড়া কেউ ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারবে না।
তবে এটা স্ববিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, বিগত সরকার হোমিও কাউন্সিল আইনে গ্র্যাজুয়েট হোমিও ফিজিশিয়ানদের ডা. ব্যবহারের স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতীয় সংসদে ‘বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা আইন ২০২৩’ পাস হয়েছে। এর মাধ্যমে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রিধারীরা এখন থেকে নামের আগে ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারবেন। ২০২৩ সালের ২ নভেম্বরে তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকের অনুপস্থিতিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন আইনটি পাসের জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। কণ্ঠভোটে আইনটি পাস হয়।
এদিকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন তাদের বকেয়া ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে মহাখালীর বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছে। তিন দিন ধরে দেশের সব কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ করে ঢাকায় অবস্থান করছেন কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা। তারা বলছেন, ১৩ বছর ধরে একই বেতনে চাকরি করায় বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার ‘কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা (সিএইচসিপি) দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন না। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, লাগাতার কর্মসূচির অংশ হিসেবে সোমবার রাজধানীর শাহবাগে সারা দেশ থেকে আসা ১৪ হাজার সিএইচসিপি এ দাবি জানান। সিএইচসিপি অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, দেশে প্রতি ৬ হাজার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য-পুষ্টি সেবা পৌঁছে দিতে প্রত্যেক কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন করে সিএইচসিপি পরিশ্রম করছেন। এখন তাদের প্রধান দাবি দ্রুত সবার চাকরি রাজস্ব খাতে নিতে হবে।
এদিকে ২০২৪ সালের গণহত্যাকারী হাসিনার ফাঁসি এবং হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ ও বিচার দাবিতে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের (টিবি গেট-মহাখালী) সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের সংগঠন এম-ট্যাব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, এই বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে ভূমিকা নিতে হবে মন্ত্রণালয়কে। দাবি প্রত্যাশিত সব গ্রুপের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি কমিশন করতে হবে। কমিশনের পরামর্শের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করতে হবে। নয়তো দেশের স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ হয়ে যাবে।