দুইশ বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান হলেও কারাগার কি পয়েন্ট ইনস্টলেশনের (কেপিআই) অন্তর্ভুক্ত নয়। বিশেষ নিরাপত্তার আওতায় নেই প্রতিষ্ঠানটি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্য থেকে দাবি উঠেছে কারাগারকে কেপিআইভুক্ত করার। এর বাইরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে পদ-মর্যাদার বৈষম্য নিরসন, যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতির সুযোগ, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য কারা কর্মকর্তাদের আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়াসহ আরও কিছু দাবি জানিয়েছে কারা অধিদপ্তর।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। যেগুলো তারা অধিদপ্তরকে জানান। পরবর্তী সময়ে অধিদপ্তর কমিটি গঠন করে দাবিগুলো পর্যালোচনা করে। কমিটি সুপারিশ সহকারে তা দাখিল করে। দাবিগুলোর মধ্যে কিছু অধিদপ্তর পর্যায়ে এবং কিছু মন্ত্রণালয় পর্যায়ে নিষ্পত্তিযোগ্য। অধিদপ্তর পর্যায়ে যেসব দাবি পূরণ সম্ভব, সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। যেগুলো মন্ত্রণালয়ের তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত আকারে জানিয়েছে কারা অধিদপ্তর।
গত ১ সেপ্টেম্বর কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় পর্যায়ে নিষ্পত্তি করার মতো ১০টি দাবি অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে। সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন চিঠির বিষয়টি কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন। কারাগারকে কেপিআইভুক্ত করার দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কারাগার এখন কেপিআইভুক্ত নয়। এটা হলে সরকারি পলিসির আওতায় কারাগারের নিরাপত্তা জোরদার হবে। যেটা জরুরি।
কারা কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়ার দাবি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মোতাহের হোসেন বলেন, এখন আমাদের অফিসাররা আগ্নেয়াস্ত্র বহন করেন না। গার্ডিং স্টাফরাই অস্ত্র বহন করেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা চাচ্ছি, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অফিসাররা যেন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পান।
অধিদপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে যে দাবিগুলো জানানো হয়েছে, তার মধ্যে আছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন গ্রেড ও মর্যাদার বৈষম্য দূরীকরণ; কারা বিভাগকে প্রিজন সার্ভিস বা বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান; অন্যান্য দপ্তর বা বাহিনীর মতো কারাগারের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য আজীবন রেশন সুবিধা দেওয়া; কারারক্ষী পদ থেকে পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি শেষে ডেপুটি জেলার ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতির সুযোগ; যৌক্তিকভাবে কারাগারের জনবল বৃদ্ধি করা; অসুস্থ বন্দিকে হাসপাতাল বা আদালতে আনা-নেওয়ার জন্য কারারক্ষীদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ; কারা বিভাগের পোশাকের রং, প্যাটার্ন ও র্যাংক ব্যাজ পরিবর্তন এবং পোশাক ও সরঞ্জামাদির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি; কারাগারের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ঝুঁকিভাতা প্রবর্তন এবং ঝুঁকিভাতা মূল বেতনের ৩০ শতাংশ হারে দেওয়া; কারা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি গার্ডিং স্টাফকে শান্তিরক্ষা মিশনে অন্তর্ভুক্তি করা; কারাগার ও ব্যক্তি নিরাপত্তায় কারা কর্মকর্তাদের জন্য আগ্নেয়াস্ত্রের প্রাধিকার প্রদান এবং কারা অধিদপ্তরের জন্য সেকশন অফিসার পদ সৃজন।
বিভিন্ন পর্যায় থেকে আসা দাবিগুলোর বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, কারারক্ষীসহ সংশ্লিষ্টদের মূল দাবি হল আপগ্রেডেশন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য বিভাগ যেমন ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি, আনসার, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কর্মচারীদের সঙ্গে কারা অধিদপ্তরের পদ মর্যাদা ও বেতন-গ্রেডের অসামঞ্জস্যতা দূর করা। কারা দপ্তরকে নিচু করে রাখার একটা প্রবণতা আছে। সবাই চায়, এটা যেন দূর হয়।
কারারক্ষীদের পদোন্নতি প্রসঙ্গে সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, আমাদের কারারক্ষীরা তৃতীয় শ্রেণিতে ঢুকে তৃতীয় শ্রেণিতেই অবসরে যান। ১৭তম গ্রেডে তারা যোগদান করেন সর্বোচ্চ ১৩ গ্রেডে গিয়ে অবসরে যান। এর ওপরে যাওয়ার সুযোগ পান না। সেজন্য আমরা যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতির কথা বলছি।
আদালত বা হাসপাতালে বন্দিদের আনা-নেওয়ার সময় কারারক্ষী দিয়ে নিরাপত্তার প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, কারাবন্দিদের হাসপাতাল বা আদালতে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা এখন পুলিশকে হস্তান্তর (হ্যান্ডওভার) করে দিই। কার্যক্রম শেষে আমাদের কাছে আবার রিটার্ন করা হয়। এই সময়টায় মোবাইলে কথা বলাসহ নানা ধরনের ঘটনা ঘটে। তখন আমাদের হেফাজতে না থাকলেও দায় চলে আসে আমাদের ওপর। যে কারণে আমরা আনা-নেওয়ার সময়টাতেও গার্ডিংয়ের দায়িত্ব নিতে চাই।
শান্তিরক্ষী মিশনে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও কারা কর্মকর্তারা খুবই সীমিত পর্যায়ে এই সুযোগ পান। এখন মাত্র একজন কর্মকর্তা মিশনে আছে জানিয়ে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, শান্তিরক্ষী মিশনে আমাদের অংশগ্রহণ লিমিটেড স্কেলে আছে। জাতিসংঘের প্রিজন এবং কারেকশন বিভাগের অংশ হিসেবে আমাদের এখান থেকে শান্তিরক্ষী মিশনে দেওয়া হয়। ওখানে কারেকশন অফিসার যান। এই মুহূর্তে আছেন মাত্র একজন। ফলে এই সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে দাবি জানিয়েছি।
কারা অধিদপ্তর থেকে জানানো দাবিগুলো এখনই চূড়ান্ত কিছু নয় জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব দাবি আমরা অধিদপ্তর থেকে সমাধান করতে পারছি, সেগুলো আমরা করছি। মন্ত্রণালয়ের বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে। এখন তারা সেগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবে। তবে এই কাজটা সময় সাপেক্ষ।