ফুসফুস মেরুদণ্ডী প্রাণীর একটি অঙ্গ, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজে ব্যবহৃত হয়। এর প্রধান কাজ হচ্ছে বাতাস থেকে অক্সিজেনকে রক্তপ্রবাহে নেওয়া এবং রক্তপ্রবাহ থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইডকে বাতাসে নিষ্কাশন করা। এই গ্যাস আদান-প্রদান করা হয় বিশেষায়িত কোষ দ্বারা তৈরি, খুবই পাতলা দেয়ালবিশিষ্ট লক্ষাধিক বায়ু থলির দ্বারা, যাকে অ্যালভিওলাই বলে। এর শ্বাসকার্য ছাড়া অন্য কাজও আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত। দেশের প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ অ্যাজমা রোগে ভুগছে। সংস্থাটি আরও জানায়, বিশ্বের সর্বোচ্চ যক্ষ্মা আক্রান্ত ২২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশের চল্লিশোর্ধ্ব মোট জনগোষ্ঠীর ২১ ভাগই ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজে (সিওপিডি) আক্রান্ত। যাদের ৬২ শতাংশ ধূমপায়ী। ফুসফুস রোগের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বায়ুদূষণ, ধূমপান, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, দরিদ্রতা, সামাজিক সচেতনতার অভাব। বাংলাদেশের ফুসফুসের প্রধান রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে সিওপিডি, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, যক্ষ্মা, আইএলডি, ফুসফুস ক্যান্সার। দিন দিন এ রোগের প্রভাব বিস্তার হচ্ছে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। অত্যধিক বায়ুদূষণের কারণে এ রোগে অকালমৃত্যুও বাড়ছে।
ফুসফুস-সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতে ফোরাম অব ইন্টারন্যাশনাল রেসপিরেটরি সোসাইটি বিশ্বব্যাপী ২৫ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব ফুসফুস দিবস ঘোষণা করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবস পালনে প্রতি বছর নির্ধারিত প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য—সবার জন্য সুস্থ ফুসফুস। প্রতি বছরের মতো এবারও রয়েছে নির্ধারিত থিম সং, দিবসকেন্দ্রিক পোস্টার, সচেতনতামূলক কর্মশালা এবং চিকিৎসকদের নিয়ে সেমিনার।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ফুসফুসের ক্যান্সার দেশে মৃত্যুর অন্যতম কারণ। পরিবেশের বিভিন্ন দূষণ এবং ধূমপানের কারণে ফুসফুসে ক্যান্সার হয়। এ ছাড়া বংশগত বা জিনগত কারণে ফুসফুস রোগাক্রান্ত হয়। পরিত্রাণের জন্য পরিবেশ দূষণ রোধসহ ধূমপান বাদ দিতে হবে। ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। ফুসফুসের রোগ প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে, সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া ফুসফুস রোগে আক্রান্ত হলে বিলম্ব না করে দ্রুত হাসপাতালে আসতে হবে।
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তালিবুল ইসলাম রুশো কালবেলাকে বলেন, ফুসফুসের রোগ মূলত তিন কারণে হয়। পরিবেশ দূষণ, মানুষের জীবনাচরণ ও জিনগত। ফুসফুসের রোগে বায়ুদূষণের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। দূষিত বায়ুর সঙ্গে নানা বিষাক্ত উপাদান ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। বায়ুদূষণের পাশাপাশি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশকেও ফুসফুসের বা শ্বাসতন্ত্রের রোগের জন্য দায়ী। এখন শুধু বস্তিতেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নয়, বরং তার চেয়েও বেশি খারাপ অবস্থা আবদ্ধ পরিবেশের ফ্ল্যাট বাসাবাড়ি কিংবা কর্মস্থলে।
সচেতনতায় পরামর্শ দিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমন্বিত একটি উদ্যোগ পারে ফুসফুসের রোগ থেকে মানুষকে বাঁচাতে। ধূমপায়ীদের ধূমপানের অভ্যাস ছাড়তে হবে। বায়ুদূষণের উৎসগুলো যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সময়মতো ঘুমাতে যাওয়া এবং তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করুন। ফুসফুসের শক্তি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়াম করার সময় জোরে শ্বাস নিতে হবে আর ধীরে ছাড়তে হবে। এতে দেহের পেশিশক্তি বৃদ্ধি পায়। কেউ ফুসফুস রোগাক্রান্ত হলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়শা আক্তার কালবেলাকে বলেন, অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের রোগে বায়ুদূষণের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। দূষিত বায়ুর সঙ্গে নানা ধরনের বিষাক্ত উপাদান থাকে, যা ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। দেশে এখন চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী মানুষের ২১ শতাংশই ভুগছে সিওপিডিতে। যাদের ৬২ শতাংশ ধূমপায়ী। প্রতিকারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ফুসফুস সুস্থ রাখতে শাকসবজি, ফল ও মাছ, বিশেষ করে টকজাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। লেবু, কমলা, মাল্টা, বাতাবি লেবু, আমড়া, বরইজাতীয় টক ফল ফুসফুসের জন্য উপকারী। ফুসফুসে প্রতিনিয়ত যে ক্ষয় হয়, সেজন্য ভিটামিন সি, ডি এবং জিঙ্কযুক্ত খাবার খাওয়া খুব জরুরি।