প্রসবকালীন মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমাতে এবং উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জেলা শহরে মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র নির্মাণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ জন্য জেলা শহরে বিদ্যমান মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র সংস্কার, নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ শীর্ষক একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে; কিন্তু প্রকল্প প্রস্তাবে অফিস ভাড়া, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন খাতে অত্যধিক ব্যয় এবং ভবন নির্মাণ ব্যয়ে অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যাচাই-বাছাই শেষে প্রস্তাবটি সংশোধনের জন্য ফেরত পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
জানা গেছে, ‘জেলা শহরে বিদ্যমান মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রকে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র নির্মাণ/পুনর্নির্মাণ/উন্নতিকরণ’ নামের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন জেলায় বিদ্যমান ৩০ শয্যার মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র ৫০ শয্যায় উন্নীত এবং নতুন ৬২ কল্যাণকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এ জন্য ২ হাজার ৭৭৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এর পুরোটাই খরচ হবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।
প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, দেশের ৫১ জেলা সদর পৌরসভা, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা এবং ১১ সিটি করপোরেশনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সরকারিভাবে সুবিধাবঞ্চিত নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়াই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা জরাজীর্ণ পুরোনো ভবন এবং পর্যাপ্ত শয্যা, চিকিৎসক, সহায়ক জনবল ও জরুরি যন্ত্রপাতির অভাব। বিদ্যমান মা ও শিশুকেন্দ্রের জমিতে কেন্দ্রগুলো স্থানান্তর করে সেখানে নতুন হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হবে।
সম্প্রতি প্রকল্পটি নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়েছে। সভায় প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাবসহ নানা অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সরকারি অর্থে ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাবের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়। ব্যয়ের বিষয়ে প্রস্তাবকারী সংস্থা থেকে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পাওয়ায় প্রস্তাবটি যৌক্তিকভাবে সংশোধনের জন্য ফেরত পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। সেইসঙ্গে অগ্রাধিকার ও চাহিদার ভিত্তিতে প্রকল্প পুনরায় প্রণয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের ব্যয়ে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যারা প্রকল্প নিচ্ছে তারা দরকষাকষির মাধ্যমে পাস করিয়ে নিতে চান। পরিকল্পনা কমিশন প্রায় সব প্রকল্পেই এ ধরনের অসঙ্গতি ধরলেও নানা অজুহাতে এসব পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাই বার বার ফেরত পাঠালে দুর্নীতি কিছুটা কমবে। পাস না হওয়ার ভয়ে যুক্তিসঙ্গত ব্যয় প্রস্তাব করবে।
পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পে ভবন নির্মাণে অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যান্য খাতেও অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। পিইসি সভায় এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়। এ ছাড়া ৫১ জেলায় ৬২টি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সব জেলায় ভবন নির্মাণ প্রয়োজন কি না- সেটা জানাতে বলা হয়েছে। সব মিলিয়ে বেশ কিছু অসঙ্গতি দেখা গেছে। এজন্য প্রকল্পটি সংশোধন করে ডিপিপি পুনর্গঠন করে আবার পাঠাতে বলা হয়েছে।
পিইসি সভা সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ৫৬ হাজার ৬৩৫ বর্গফুটের ৬২টি ৮ তলাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ১৪২ কোটি ৯০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর লিফটসহ মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ১০ লাখ ৬ হাজার। ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফার্নিচার ও লিফট বাদে প্রতি বর্গফুট নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৬৫৩ টাকা, যা অনেক বেশি।
এ ছাড়া প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়নকালে চলমান হাসপাতাল কার্যক্রম সচল রাখতে ভবন ভাড়ার জন্য মোট ৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ ব্যয় প্রাক্কলনের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পের জন্য ৪ দশমিক ৪০ একর ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ১৮ কোটি সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে পত্র ডিপিপিতে পাওয়া যায়নি।
এদিকে, গাজীপুর মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রে বৈদ্যুতিক সাব স্টেশন নির্মাণে প্রস্তাব করা হয়েছে ৮৬ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা, এ ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটের প্রাক্কলিত ব্যয় ৪ হাজার ৬৯৫ টাকা। একই অবস্থা মানিকগঞ্জ মা ও শিশু কেন্দ্রের। মানিকগঞ্জ ও গাজীপুর মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রের বিভিন্ন আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন সংস্কার বা পুনর্নির্মাণে আনুষঙ্গিক কাজের জন্য ৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। নতুন ফাউন্ডেশনের প্রয়োজন না হলেও প্রাক্কলিত ব্যয় অত্যধিক ধরা হয়েছে। এই ব্যয় অনেক বেশি বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।
জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২৫ হাজার ৫৩৬ আসবাবপত্র বাবদ ৪৬ কোটি ৩৫ লাখ ৩২ হাজার টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে; কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন মনে করে, আসবাবপত্রের সংখ্যা ও ব্যয় প্রাক্কলন অত্যধিক। এ ছাড়া প্রাধিকার ভিত্তিতেও আসবাবপত্র নির্ধারণ করা হয়নি। এক্ষেত্রে ৩ সদস্যের একটি কমিটি করে আসবাবপত্রের সংখ্যা ও মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রকল্পে প্রস্তাবিত ক্রয় প্যাকেজ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। ক্রয় পরিকল্পনায় ১৩৬ প্যাকেজ রয়েছে। এ সংখ্যা অনেক বেশি প্রতীয়মান হয়েছে। প্যাকেজের সংখ্যা কমানো উচিত বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৮টি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বাবদ ২৫৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে এসব যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয়তা ও প্রাক্কলিত মূল্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পর্কেও জানতে চেয়েছে কমিশন। এ ছাড়া প্রকল্পের অর্থ বিভাগের জনবল নির্ধারণ-সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।