স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদ্যমান উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) হালনাগাদ করতে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জিকে নিয়োগ দিয়েছে পেট্রোবাংলা। গত ২২ ডিসেম্বর পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেলেও কোম্পানিটি কাজ শুরু করবে আগামী সপ্তাহ থেকে। আগামী মাসে স্থলভাগের পিএসসি চূড়ান্ত করা হবে। তারপর অনুমোদনের জন্য জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে পাঠানো হবে। পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে, বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ডাকা দরপত্র এবং জরিপের তথ্য কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি কিনলেও শেষ পর্যন্ত আর অংশ নেয়নি। এর কারণ জানতে পেট্রোবাংলার গঠিত কমিটির ডাকেও কোম্পানিগুলো সাড়া দেয়নি বলে জানা গেছে।
১৯৯৭ সালের পর স্থলভাগের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে পিএসসি আর হালনাগাদ করা হয়নি। সম্প্রতি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়ার পর বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ২৭ বছর পর পিএসসি হালনাগাদের উদ্যোগ নেয় পেট্রোবাংলা। পিএসসি চূড়ান্তকরণের পর পার্বত্য অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করবে সংস্থাটি।
জানা গেছে, গত এক দশকে স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস উত্তোলন দিন দিন কমছে। দেশে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে এই সময়ে আমদানির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। বড় বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলোরও মজুত ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। এ অবস্থায় স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে স্থলভাগের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে পিএসসি হালনাগাদ করা হচ্ছে। এই হালনাগাদ করতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি উড ম্যাকেঞ্জিকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার চেয়ে কম সময়ে স্থলভাগের অনুসন্ধান কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। পিএসসি হালনাগাদের পাশাপাশি আকর্ষণীয়ও করা হচ্ছে। গ্যাস পেলে উৎপাদিত গ্যাসের অংশীদারত্বে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। দ্বিমাত্রিক জরিপের ভিত্তিতে উচ্চ সম্ভাবনাময়, মাঝারি সম্ভাবনাময় ও ন্যূনতম সম্ভাবনাময়—এই তিন ক্যাটাগরিতে ব্লকগুলো ভাগ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রে দেশীয় অনুসন্ধান কোম্পানিগুলোকে অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর টেকনিক্যাল, ফিন্যান্সিয়াল ও দক্ষ মানবসম্পদের ওপর ভিত্তি করে কাজ পাওয়ার সুযোগ রাখা হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে তিনটি রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি হলো বাপেক্স, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি ও সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, স্থলভাগে মোট ২২টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১১টিতে এখনো কোনো ধরনের অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হয়নি।
খালি থাকা ব্লকগুলো হচ্ছে ১, ২এ, ২বি, ৩এ, ৪এ, ৪বি, ৫, ৬এ, ২২এ, ২২বি ও ২৩ নম্বর। এসব ব্লকে কাজ করতে যোগ্যতম বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ কোম্পানি গঠন করে দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। এ ছাড়া এই খাতের কোনো কোম্পানিকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কাজ করানোর সুযোগ রাখা হচ্ছে হালনাগাদ পিএসসিতে। স্থলভাগের গ্যাসের দামও বাড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।
দেশের স্থলভাগে প্রথম পিএসসি করা হয় ১৯৯১ সালে। এর অধীনে বিবিয়ানা, জালালাবাদ ও মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রের কাজ পায় শেভরন। পরে ১৯৯৭ সালে সংশোধিত পিএসসির অধীনে কুমিল্লার বাঙ্গুরায় কাজ পায় তাল্লো। তবে কানাডিয়ান কোম্পানিকে টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রের কাজ দেওয়া হয় পিএসসি ছাড়াই।
বর্তমানে দেশের ২২টি গ্যাসক্ষেত্রের ১১৩টি কূপ দিয়ে দৈনিক ১ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার পেট্রোবাংলার গ্যাস উৎপাদনের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এদিন এসব কূপ থেকে ১ হাজার ৭১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন হয়েছে। এর সঙ্গে আমদানি করা ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি যোগ করে জাতীয় গ্রিডে মোট ২ হাজার ৭১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।
স্থানীয়ভাবে সবচেয়ে বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হয় সিলেটের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে। মার্কিন কোম্পানি শেভরনের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই গ্যাসক্ষেত্রের ২৬টি কূপ দিয়ে দৈনিক ৭৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করে সরবরাহ করা হচ্ছে। শেভরনের নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্য দুটি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে জালালাবাদ ফিল্ডের সাতটি কূপ দিয়ে দৈনিক ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রের পাঁচটি কূপ দিয়ে দৈনিক সাড়ে ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এককভাবে শেভরন সবচেয়ে বেশি গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করছে। অন্য বহুজাতিক কোম্পানি তাল্লো বাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্রের পাঁচটি কূপ দিয়ে দৈনিক ২১ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করছে।
দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স আটটি গ্যাসক্ষেত্রের ১৫টি কূপ দিয়ে ১১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করছে। এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো হচ্ছে সালদা, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর, সেমুতাং, শ্রীকাইল, সুন্দলপুর, বেগমগঞ্জ ও রূপগঞ্জ। সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (এসজিএফএল) সিলেট, কৈলাশটিলা-১, কৈলাশটিলা-২, রশিদপুর ও বিয়ানীবাজার এই পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রের ১১টি কূপ দিয়ে দৈনিক ১১৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করছে। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (বিজিএফসিএল) পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রের ৪৪টি কূপ দিয়ে দৈনিক ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করছে। গ্যাসক্ষেত্রগুলো হচ্ছে তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, নরসিংদী এবং ম্যাগনামা। এর মধ্যে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রটি সবচেয়ে পুরোনো।
সাগরের দরপত্রে অংশ না নেওয়ার কারণ জানায়নি কোম্পানিগুলো: বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আহ্বান করা আন্তর্জাতিক দরপত্রে কোনো বহুজাতিক কোম্পানির অংশ না নেওয়ার কারণ জানতে গত ১২ ডিসেম্বর কমিটি গঠন করে পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলার পরিচালককে (প্রোডাক্টশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট-পিএসসি) প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়।
বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল ও শেভরন, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস, নরওয়ে ও ফ্রান্সের যৌথ কোম্পানি টিজিএস অ্যান্ড স্লামবার্জার, জাপানের ইনপেক্স করপোরেশন ও জোগম্যাক, চীনের সিনুক, সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি এবং ভারতের ওএনজিসি আগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন সময় পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এর মধ্যে সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনেছিল শেভরন, এক্সনমবিল, ইনপেক্স, সিনুক ও জোগোম্যাক। শেষ পর্যন্তু তাদের কেউ আসেনি দরপত্রে।
এসব কোম্পানি কেন দরপত্রে অংশ নেয়নি, এর কারণ জানতে চেয়ে কোম্পানিগুলোকে চিঠি দিয়েছে কমিটি। কিন্তু কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন বছর ও বড়দিনের কারণে তারা জবাব দিতে পারেনি। আগামী সপ্তাহে পুনরায় তাদের চিঠি দেওয়া হবে।