অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটের কারণে হুমকির মুখে দেশের বীমা খাত। বিশেষ করে মালিক পক্ষের আর্থিক লুটের কারণে দেশের সিংহভাগ কোম্পানিই গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধ করতে পারছেন না। আর লুটে সহায়তা করছেন মালিক পক্ষের পছন্দের প্রধান নির্বাহীরা। শুধু তাই নয়, এ কারণে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সিইও নিয়োগ না দিয়ে পছন্দের কর্মকর্তাদের ভারপ্রাপ্ত সিইওর দায়িত্ব দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নিয়োগ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত বা চলতি দায়িত্ব হিসেবে কোনো কর্মকর্তাকে সিইও নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বীমা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইওর কাছে পাঠানো প্রজ্ঞাপনে এই নির্দেশনা দিয়েছে আইডিআরএ। এর আগে ২০২০ সালের এ সংক্রান্ত আরও একটি নির্দেশনা জারি করে সংস্থাটি।
আইডিআরএর পরিচালক মোহা. আবদুল মজিদ স্বাক্ষরিত নতুন নির্দেশনায় বলা হয়, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত না হলে কেউ মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না। এ ছাড়াও কোনো বীমা কোম্পানিতে ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব)’ হিসেবে কাউকে নিয়োগ করা যাবে না এবং এ পদবিও ব্যবহার করতে পারবেন না।
চিঠিতে আরও বলা হয়, আইডিআরএ এ কর্তৃক অনুমোদিত না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বিধান অনুসরণ করে একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া যাবে এবং তিনি ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত)’ পদবি ব্যবহার করতে পারবেন।
তবে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত)-এর নিম্নপদে কোনো কর্মকর্তা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে পাঠানো চিঠিতে সই করতে পারবেন না। সব বীমাকারী ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারা এই নির্দেশনার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবেন বলেও উল্লেখ করা হয়।
এর আগে ২০২০ সালের নির্দেশনায় আইডিআরএ জানায়, বীমা আইন অনুযায়ী কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের কোনো প্রস্তাবিত ব্যক্তির নিয়োগ প্রস্তাব বা চুক্তি শেষ হওয়ার পর নিয়োগ নবায়ন প্রস্তাব নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুমোদন না দেওয়া পর্যন্ত নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে বেতন-ভাতাসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা নিতে পারেন না।
একইভাবে আইডিআরএর অনুমোদন ছাড়া মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবার বীমা আইন অনুযায়ী, জীবন বীমা করপোরেশন ও সাধারণ বীমা করপোরেশন ছাড়া অন্য কোনো বীমা কোম্পানিতে ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালক’ পদ ব্যবহারের সুযোগ নেই। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর জন্য ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)’ পদ প্রযোজ্য।
আইডিআরএর তথ্য মতে, বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ ৩ মাস বা সর্বসাকল্যে ছয় মাসের বেশি খালি রাখা যায় না। কিন্তু বছরের পর বছর এ পদটি ভারপ্রাপ্ত বা চলতি দায়িত্বে চালানোর ঘটনা লক্ষ করা যাচ্ছে। আইডিআরএ এই ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সিইও নিয়োগে আইন না মানা কোম্পানিগুলো হলো—গার্ডিয়ান লাইফ, আকিজ তাকাফুল লাইফ, সোনালী লাইফ, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ, যমুনা লাইফ, সান লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ ও বায়রা লাইফ।
জানা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স শেখ রাকিবুল করিমকে ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে দায়িত্ব দেয়। তিনি তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন, যা আইনসিদ্ধ নয়। একই অবস্থা আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। ২০২১ সালের ২৭ জুন মোহম্মদ আলমগীর চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে যোগ দেন। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে সেই দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও তার পূর্ণাঙ্গ সিইও পদে নিয়োগের জন্য আবেদন আইডিআরএ নাকচ করে দেয়।
২০২০ সালে মীর রাশেদ বিন আমানকে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে যোগ দেন। তবে তিন বছর পর অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের কারণে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বর্তমানে মো. রফিকুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তার মেয়াদও ছয় মাস ছাড়িয়েছে।
মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সও চলছে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা দিয়ে। গত বছর আগস্টে এসকে. আব্দুর রশিদকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই দায়িত্বের মেয়াদও ছয় মাস হতে চলেছে। পূর্ণাঙ্গ সিইও নিয়োগে কোনো তোড়জোড় নেই।
গত বছর ২৯ আগস্ট থেকে যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) চলতি দায়িত্ব পালন করা ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলকে গেল ১৪ জানুয়ারি অব্যাহতি দেওয়া হয়। ফলে সিইও শূন্য রয়েছে কোম্পানিটি।
‘সিইও তৈরির কারখানা’ হিসেবে পরিচিত বায়রা লাইফও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগে নিয়ম মানছে না। বর্তমানে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন কোম্পানির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার ও কোম্পানি সেক্রেটারি মো. মামুন খান। সেই মেয়াদ ছয় মাস অতিক্রম করেছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা।
হোমল্যান্ড লাইফে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ আবদুল মতিন। তার দায়িত্ব পালনের মেয়াদ তিন মাস শেষ হয়েছে।
মন্তব্য করুন