বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে করা উৎপাদন বণ্টন চুক্তি-২০২৩ (প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক-পিএসসি) সংশোধন ও আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গুরুত্বপূর্ণ চারটি বিষয়ে সংশোধন আনা হচ্ছে। এগুলো হলো ডাটার দাম, ওয়ার্কার্স প্রফিট বোনাস, গ্যাসের দাম ও কস্ট রিকভারি। এরই মধ্যে এসব নিয়ে কাজ শুরু করেছে পেট্রোবাংলা।
বঙ্গোপসাগরের মোট ২৪টি ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য গত বছরের ১১ মার্চ আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। একবার সময় বাড়ানোর পর দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল একই বছরের ৯ ডিসেম্বর। বেশ কয়েকটি কোম্পানি শুরু থেকে আগ্রহ দেখালেও দরপত্রে অংশ নেয়নি আন্তর্জাতিক কোনো কোম্পানি। সে সময় কোম্পানিগুলোর কাছে এর কারণ জানতে চাওয়া হয় পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে। পাশাপাশি কারণ জানতে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। পরে দরপত্রে অংশ নিতে আগ্রহী ছিল—এমন কয়েকটি কোম্পানি কমিটির কাছে কারণ জানায়। কারণগুলো পর্যালোচনা করে কমিটির দেওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে পিএসসি সংশোধন করা হচ্ছে বলে জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সর্বশেষ গত ৪ মার্চ এ কমিটির বৈঠক হয়।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘পিএসসি সংশোধনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। চারটি বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে কোম্পানিগুলো। চারটির মধ্যে দুটি বিষয় আমাদের আয়ত্তের মধ্যে রয়েছে। বাকি দুটি অন্যদের হাতে। এর একটি হলো জরিপ ডাটার দাম। বঙ্গোপসাগরে জরিপ করেছে আন্তর্জাতিক কোম্পানি। তারা তাদের ডাটা কী দামে বিক্রি করবে, সেটা আমাদের হাতে নেই। অন্যটি হলো পিএসসি ওয়ার্কার্স প্রফিট বোনাসের রেশিও কমানো। এটা শ্রম মন্ত্রণালয়ের হাতে। আমরা তাদের অনুরোধ করেছি।’
তিনি আরও জানান, ‘আমাদের হাতে যে দুটি বিষয় রয়েছে, এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। এগুলো হলো গ্যাসের দাম ও কস্ট রিকভারির রেশিও বাড়ানো।’
জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল ও শেভরন, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস, নরওয়ে ও ফ্রান্সের যৌথ কোম্পানি টিজিএস অ্যান্ড স্লামবার্জার, জাপানের ইনপেক্স করপোরেশন ও জোগম্যাক, চীনের সিনুক, সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি এবং ভারতের ওএনজিসি আগ্রহ প্রকাশ করে। দরপত্র আহ্বানের আগে থেকেই এসব কোম্পানি পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনেছিল শেভরন, এক্সনমবিল, ইনপেক্স, সিনুক ও জোগোম্যাক। সাতটি কোম্পানি দরপত্র সংগ্রহ করলেও নির্ধারিত সময়ে কেউই জমা দেয়নি।
জানা গেছে, মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল দুটি বিষয় সামনে এনেছে। এগুলো হচ্ছে গভীর সমুদ্র থেকে স্থলভাগে আনা পাইপলাইনের খরচ হিসেবে সঞ্চালন চার্জ না রাখা এবং ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) নিয়ে আপত্তি। বিদ্যমান আইনে কোম্পানির মুনাফার ৫ শতাংশ ডব্লিউপিপিএফে হস্তান্তরের বিধান রয়েছে, যা নিয়ে বর্তমানে অপর মার্কিন কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশের সঙ্গে এখনো টানাপোড়েন চলছে। এই ৫ শতাংশ কমানোর জন্য এরই মধ্যে জ্বালানি বিভাগ থেকে শ্রম মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে চায়না ন্যাশনাল অফশোর অয়েল করপোরেশন (সিএনওওসি) তার জবাবে লিখেছে, পেট্রোবাংলা তাদের ডাটা বিক্রির জন্য যে প্যাকেজমূল্য নির্ধারণ করেছিল, তার দর অনেক বেশি ছিল। গ্যাসের দাম কমিয়ে রাখার বিষয়টিও সামনে এনেছে একটি কোম্পানি। তাদের দাবি, পিএসসি চূড়ান্তকরণে কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান দামের যে সুপারিশ দিয়েছে, তা রাখা হয়নি।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বহুমাত্রিক জরিপ (মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে) করে আন্তর্জাতিক কোম্পানি টিজিএস-স্লামবার্জার। এজন্য বাংলাদেশ তাদের কোনো অর্থ দেয়নি। শর্ত হচ্ছে, জরিপের ডেটা তারা অনুসন্ধানে আগ্রহী কোম্পানগিুলোর কাছে বিক্রি করবে। ফলে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনুরোধ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে দাম কমানোর জন্য তাদের বলা হবে। এ ছাড়া মডেল পিএসসি-২০২৩-এর গ্যাসের দাম নির্ধারিত করা হয়নি। ব্রেন্ট ক্রুডের আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে ওঠানামা করবে গ্যাসের দর। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রুডের ১০ শতাংশ দরের সমান। অর্থাৎ ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৯০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ৯ ডলার। তেলের দাম বাড়লে গ্যাসের দামও বাড়বে, কমলে এটিও কমবে। এটি ১২ শতাংশ করার দাবি করেছে কয়েকটি কোম্পানি।
এ ছাড়া মডেল পিএসসি-২০২৩ কস্ট রিকভারিতে আর্লি প্রভিশন রাখা হয়েছে। উৎপাদনে আইওসির (ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি) জন্য অংশীদারত্ব মোটের ওপর ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। কস্ট রিকভারি যাতে তাড়াতাড়ি হয়, সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে এলএনজি দামের চেয়ে কোনো অবস্থাতেই যেন বেশি দামে গ্যাস কিনতে না হয়, সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল পিএসসিতে। কিন্তু কয়েকটি কোম্পানি এই কস্ট রিকভারি প্রভিশনে পরিবর্তন করা বলেছে।
ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সাগর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। ২০১০ সালে গভীর সমুদ্রে ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ ব্লকে কাজ নেয় কনোকো ফিলিপস। তারা দ্বিমাত্রিক জরিপ শেষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি করে। সেই দাবি পূরণ না হওয়ায় কাজ ছেড়ে চলে যায়। এ ছাড়া চুক্তির পর কাজ ছেড়ে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ার স্যান্তোস ও দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু। সর্বশেষ মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল গত ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের আগে বঙ্গোপসাগরের সব ব্লক ইজারা চেয়ে দেনদরবার করে। কিন্তু ওই সময় ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সব ব্লক ইজারা দিতে চায়নি। তারপরও এক্সনমবিলের প্রতিনিধিদল ব্লক ইজারার বিষয়ে ঢাকা সফর করে।
মন্তব্য করুন