কারিগরি সহায়তা প্রকল্পে সমীক্ষা হলেও কৃষক কিংবা ব্যবসায়ীদের চাহিদা, বাজার যাচাই না করেই ব্যক্তিস্বার্থে কেনা হয় লাগেজ ভ্যান। প্রয়োজন নেই জেনেও লাভ দেখিয়ে রেলওয়ের সেই সময়কার কিছু কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের যোগসাজশে এই লাগেজ ভ্যান কিনতে ব্যয় হয় ৩৫৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। পণ্য পরিবহনে রেলের আয় বাড়বে—এমন লাভের আশার গল্প শোনালেও বাস্তবে প্রতিনিয়ত বাড়ছে লোকসানের বোঝা। লাভের পরিবর্তে এগুলো এখন রেলওয়ের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। আর তাই এখন লাগেজ ভ্যান পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি খাতে দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে রেল মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, প্রয়োজন নেই জেনেও লাভ দেখিয়ে কারা লাগেজ ভ্যান কিনিয়েছিল, তা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করুন। যারা বিদেশি ঋণে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে অপচয় করেছে, তাদের খুঁজে বের করে জবাবদিহি আদায়ের চেষ্টা করবেন বলেও জানান রেল উপদেষ্টা।
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শেই এসব লাগেজ ভ্যান কেনা হয়েছিল। আর এই লাগেজ ভ্যান উদ্বোধনকালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন দাবি করেছিলেন, সরকারের কৃষিবান্ধব নীতিতে এসব ভ্যান কেনা হয়েছে। যদিও রেলওয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, রেলের তৎকালীন সময়ের কর্মকর্তা এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই লাগেজ ভ্যান কেনা হয়েছিল। এই চক্রটি কমিশন নিয়ে রেলের ঘাড়ে লোকসানের বোঝা তুলে দিয়েছে।
রেলের নথিপত্রে দেখা যায়, লাগেজ ভ্যান কিনতে ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট ৩৫৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকার চুক্তি হয় চীনের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এ সময় প্রতিটি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যানের দাম ৩ কোটি ৫ লাখ এবং প্রতিটি মিটার গেজ লাগেজ ভ্যানের দাম ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রেলওয়ের বহরে যুক্ত হয় ১২৫ লাগেজ ভ্যান।
রেলওয়ে ২০২০ সালে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ চালু করে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত আম পরিবহনে সংস্থাটির লোকসান হয় ১ কোটি ৮২ হাজার ৮৬০ টাকা। এর পরও লাভের কথা বলে কেনা হয় লাগেজ ভ্যান। আয় বাড়ানোর গল্প শুনিয়ে গত বছর ২৪ অক্টোবর চালু করে ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন’। এতেও সাড়া না পাওয়ায় এক সপ্তাহের মাথায় তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এরই মধ্যে রেলওয়ের লোকসান হয় বিশাল অঙ্কের টাকা।
জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক সিদ্দিকুর রহমান ময়েজ এ বিষয়ে বলেন, যেহেতু জমিতে বসেই ফসল ঢাকায় পাঠানো যায়, তাই উদ্যোক্তা কিংবা ব্যবসায়ীরা ট্রেনে পণ্য পরিবহনে খুব বেশি আগ্রহী নন। তবে কৃষিপণ্য যদি রেল কর্তৃপক্ষ আড়ত বা মার্কেটে পৌঁছে দেয়, তাহলে উদ্যোক্তা কিংবা ব্যবসায়ীদের ট্রেনে পণ্য পরিবহনে আগ্রহ বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাদীউজ্জামান বলেন, কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের নামে সমীক্ষায় ভাঁওতাবাজি করা হয়েছে। যারা সমীক্ষা, প্রকল্প যাচাই, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করেছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় না আনলে প্রকল্পের নামে লুটপাট বন্ধ হবে না। লাগেজ ভ্যান যে অস্বাভাবিক দামে কিনেছে, তার চেয়ে অনেক কম দামে যাত্রীবাহী কোচ (বগি) কেনা যায়। লাগেজ ভ্যানে এমন কী আছে যে, এগুলো এত দাম দিয়ে কিনতে হবে? তা ছাড়া লাগেজ ভ্যান কিনতে নানা পরিকল্পনা করলেও বাস্তবে এসব লাগেজ ভ্যান ব্যবহারে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের তেমন উৎসাহী করতে পারেনি রেলওয়ে।
নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ‘রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কেনা হয়। ‘রোলিং স্টক উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদনকালে রেলের মহাপরিচালক (ডিজি) ছিলেন আমজাদ হোসেন। আর দরপত্র ও ক্রয়চুক্তির সময় ডিজি ছিলেন শামসুজ্জামান। এ দুজনই চাকরি থেকে স্বাভাবিক অবসরে গেছেন।
সাবেক দুই ডিজির সঙ্গে লাগেজ ভ্যান কেনা ও লোকসান বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তারা কোনো ধরনের বক্তব্য দিতে রাজি হননি। ২০১৭ সালের ১ জুলাই শুরু হওয়া প্রকল্পের আগামী ৩০ জুন মেয়াদকাল শেষ হবে। প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. বোরহান উদ্দিন। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বোরহান উদ্দিনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অর্থ) রফিকুল বারি খান বলেন, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের দাবির কথা আমরা জেনেছি। এ মুহূর্তে তাদের দাবি বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও বিষয়টি বিবেচনাধীন।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশিদ বলেন, লাগেজ ভ্যান ক্রয়ের সমীক্ষা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত রেলওয়ের এবং মন্ত্রণালয়ের যারা যুক্ত ছিলেন, তারাই এমন অবস্থার জন্য দায়ী। তাদের প্রত্যেককে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (উন্নয়ন) মইনুল ইসলাম বলেন, ট্রেনে পণ্য পরিবহন বিষয়ে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের তেমন একটা ধারণা নেই। তবে রেলওয়ের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আশা করি লাগেজ ভ্যানে পণ্য পরিবহন বাড়বে।
মন্তব্য করুন