পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় ‘আইনি সহায়তার’ অজুহাতে ফোনে ডেকে নিয়ে আসা দুজনের মাধ্যমে কীটনাশকের বোতল সংগ্রহ করেন ফিরোজা আশরাফী। ওষুধের সেবনের কথা বলে সেই বিষ (কীটনাশক) পানি দিয়ে গুলিয়ে থানার মধ্যেই পান করেন ফিরোজা। ঘটনার সময় পুলিশের নারী সদস্যরা ফিরোজাকে ‘বিষ পান’ করতে বাধা দেন। নারী পুলিশ সদস্যরা ওই নারীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন; কিন্তু তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ঘটনার পাঁচ দিন আগে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে বিষ আনিয়ে রাখেন ফিরোজা। ভাটারা থানা পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ ঘটনায় ভাটারা থানায় একটি মামলা হয়েছে। হেফাজতে থাকা অবস্থায় বিষপানে বন্দির মৃত্যুর কারণে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ভাটারা থানা পুলিশের তিন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
ভাটারা থানার ওসি রাকিবুল হাসান বলেন, ‘এ ঘটনায় আমাদের থানায় আত্মহত্যার চেষ্টা ও প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়েছে। বিষ এনে দেওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সদস্য পরিচয় ব্যবহার করে ‘আইনি সহায়তা’ দেওয়া দুজনকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তার দুজনের নাম শোভা ও কনা। তারা ট্রান্সজেন্ডার। মূলত ভুক্তভোগী নারী এই দুজনকে দিয়ে কৌশলে বিষ আনিয়ে নেন এবং তাদের দিয়েই গুলিয়ে নিয়ে সেটা পান করেন।’
ওসি বলেন, ‘এই নারীর সঙ্গে বর্তমানে স্বামী পরিচয় দেওয়া ব্যক্তির সঙ্গে দাম্পত্য কলহ চলছিল। এর মধ্যেই অনলাইনে অর্ডার করে কীটনাশকের বোতলটি নিয়ে আসেন।’ ব্লাস্টের লিগ্যাল এইড কর্মকর্তাদের এর সঙ্গে যোগসূত্র কী—এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘বিষপানে’ নিহত নারী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাকে ‘স্বামীর গোপনাঙ্গ’ কেটে নেওয়ার অভিযোগে হেফাজতে আনা হয়েছিল। একই প্রতিষ্ঠানের ইসমাইল সুজন নামে এক প্রভাষককে ফিরোজার স্বামী পরিচয় দেন। তবে সুজনের পরিবার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছে, সুজনের স্ত্রী নন ফিরোজা। পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘নিহত নারী ও আহত পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা গত মার্চে বিয়ে করেছেন। তবে দুজনের আগে একটি করে বিয়ে হয়েছিল। এ কারণে তাদের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। এর মধ্যে সুজন অন্য একটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন বলে সন্দেহ করেন ফিরোজা। এটা নিয়ে দাম্পত্য কলহ লেগেই ছিল। এ কারণে ফিরোজা অনেক আগেই ব্লাস্টের সদস্যদের কাছে আইনি সহায়তা চেয়েছিলেন। ঘটনার দিন ব্লাস্ট থেকে তাকে সহায়তা করতে আসেন শোভা ও কনা। তাদের দিয়েই কৌশলে বিষ আনিয়ে পান করেন ফিরোজা। ওসি বলেন, এসব আমরা শোভা ও কনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছি।’
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ব্লাস্টের লিগ্যাল এইড শাখার পরিচালক মো. বরকত আলীকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া গণমাধ্যম শাখায় বক্তব্য চাওয়া হলে ব্লাস্টের লিগ্যাল এইড শাখায় যোগাযোগ করতে বলা হয়।
জানা গেছে, ‘ঘুমন্ত অবস্থায় স্বামীর গোপনাঙ্গ কেটে দেন ফিরোজা। এরপর ফিরোজা নিজেই তাকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করান। তার স্বামীর পরিবারের লোকজন হাসপাতালে আসার পর বিকেলের দিকে ফিরোজার সঙ্গে তাদের বাগবিতণ্ডা হয়। বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে ফিরোজা নিজেই ৯৯৯-এ কল করেন। পরে তাকে ভাটারা থানা পুলিশের একটি দল আটক করে।
এদিকে পল্লবী পুলিশ জানিয়েছে, স্বামীর গোপনাঙ্গ কেটে দেওয়ার ঘটনায় ফিরোজার বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা হয়েছে। কারণ, সুজনের বাড়ি রাজধানীর পল্লবীতে। ঘটনার বিস্তারিত শুনে ভাটারার পুলিশ ওই নারীকে পল্লবী থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পল্লবী থানা তখন ফিরোজাকে আপাতত ভাটারা থানা পুলিশের হেফাজতে রাখতে বলে। থানা হেফাজতে থাকা অবস্থায় ফিরোজা বিষ পান করেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভিকটিম সুজন বর্তমানে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। পল্লবী থানার মামলার আসামি ফিরোজা বিষপানে মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন, ‘সুজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। তবে সুজনের পরিবার তা স্বীকার করেনি। পুলিশ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে।’
থানা হেফাজতে ফিরোজার মৃত্যুর ঘটনায় ‘দায়িত্বে অবহেলার’ অভিযোগে ঢাকার ভাটারা থানার তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করার তথ্য দিয়েছেন বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাকিবুল হাসান। বরখাস্ত পুলিশ সদস্যরা হলেন এসআই জামাল হোসেন, কনস্টেবল শারমিন ও নাছিমা।
মন্তব্য করুন