স্বাধীনচেতা মানবতার আর্তি, প্রতিবাদী চেতনার উন্মেষ আর ইতিহাসের রক্তিম স্মৃতির সম্মিলনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে চলছে ‘জুলাই উপজীব্য শিল্পকর্ম প্রদর্শনী’। ক্যানভাস, ভাস্কর্য, ইনস্টলেশন ও আলোকচিত্রে জীবন্ত হয়ে উঠেছে ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লব—যেখানে ধ্বনিত হয়েছে জাগরণ, প্রতিরোধ ও পরিবর্তনের অনন্ত বার্তা।
শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালায় প্রবেশ করলেই যেন খুলে যায় এক অদৃশ্য দরজা, যা দর্শনার্থীদের টেনে নেয় ইতিহাসের গভীরে। এটি কেবল একটি শিল্পপ্রদর্শনী নয়, এটি এক জাতির স্মৃতিচারণ, জনগণের সাহসিকতার কাব্য, আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পথনির্দেশ।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালায় গত সোমবার জুলাই পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠানমালার অন্তর্ভুক্ত জুলাই বিপ্লব উপজীব্য শিল্পকর্ম প্রদর্শনী-২০২৫ শুরু হয়। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম শেখ। তিনি বলেন, এ প্রদর্শনী কেবল শিল্প নয়, এটি আমাদের সময়ের ইতিহাস, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাহস জোগাবে।
গণঅভ্যুত্থানের ক্ষতচিহ্নে ভরা দেয়ালগুলো: চিত্রশালার নিচতলার প্রধান ফটকের বাইরে আন্দোলনের সময়কার বিভিন্ন চিত্র ব্যানার আকারে সাঁটানো হয়েছে। তৃতীয় তলার লবিতে ঢুকতেই কানে বাজে প্রতিবাদী সুর—র্যাপার হান্নান ও সেজানের গান, যা আন্দোলনের আবেগকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। দেয়ালে টানানো ব্যঙ্গচিত্রে উঠে এসেছে রাজনীতির নির্মমতা—শেখ হাসিনার উড়োজাহাজে পলায়ন, হেলমেট বাহিনীর নৃশংসতা, শাসকশ্রেণির ভণ্ডামির চিত্র। প্রথম গ্যালারিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি সারি সাজানো এক্স-রে রিপোর্ট; গুলিতে ক্ষতবিক্ষত মানুষের মাথার খুলি, হাত, বুক ও পায়ের এক্স-রে। এগুলো শুধুই চিকিৎসাবিষয়ক দলিল নয়, এগুলো নীরব অথচ ভীষণ শক্তিশালী সাক্ষ্য, যা মনে করিয়ে দেয় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিভীষিকাময় দিনগুলোকে।
পাশের দেয়ালে আন্দোলনের বিভিন্ন মুহূর্ত—পুলিশের হাতে নিপীড়নের শিকার তরুণ, শহীদ মীর মুগ্ধর পানির বোতল হাতে শেষ ছবি, আর এক সাধারণ রিকশাওয়ালার প্রতিবাদী স্যালুট; যেন পুরো জাতি এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল ন্যায় ও ন্যায্যতার দাবিতে।
তিনটি তথ্যচিত্রে দিনভিত্তিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের প্রতিটি দিনের ঘটনাবলি। দর্শকরা দেখতে পান কীভাবে একেক দিন নতুন নতুন প্রতিবাদ গড়ে ওঠে, কীভাবে নিপীড়নের মাঝেও মানুষের সাহস থেমে যায়নি।
গ্যালারি-৩ হলো পুরো প্রদর্শনীর হৃদয়। এখানে প্রদর্শিত হয়েছে আন্দোলনের সবচেয়ে আলোচিত আলোকচিত্রগুলো। ক্ষতবিক্ষত পা আর রক্তমাখা শরীর, সহযোদ্ধার কাঁধে শহীদের লাশ নিয়ে মিছিল, সংস্কৃতিকর্মীদের প্রতিবাদী শোভাযাত্রা, হাসপাতালে আহতদের মুখে অবিশ্বাস্য নির্মল হাসি, লাল রঙে আঁকা জুলাইয়ের প্রতীকী চিত্র, এমনকি ছররা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া শরীরের এক্স-রে।
এই প্রদর্শনীতে শিল্পীরা নানা মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রতিবাদ, বেদনা ও আশার সুর। প্রদর্শনীতে রয়েছে ৫০ শিল্পীর ৬৭টি গ্রাফিতি, ২০ শিল্পীর ২৩টি ক্যানভাস, ১২ শিল্পীর ১৬টি ভাস্কর্য, ৩৪ শিল্পীর ৩৪টি ই-সুতার কাজ, ৩ শিল্পীর ১৫টি পোস্টার, ৩ শিল্পীর ১১টি ব্যঙ্গচিত্র, ১০ আলোকচিত্রীর ৭১টি ছবি। মোট ১৩২ জন শিল্পীর ২৩৭টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে এ আয়োজনে। এই প্রদর্শনী প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। চলবে আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত।
মন্তব্য করুন