জ্বালানি সংকট, ব্যাংকিং খাতে অসহযোগিতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্ডার না থাকা, কার্যাদেশ বাতিল, ঘন ঘন শ্রমিকদের আন্দোলন, ভাঙচুরসহ বৈশ্বিক নানা সংকটে গাজীপুরে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক তৈরি পোশাক কারখানা। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন লাখো শ্রমিক।
ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিকসহ বিভিন্ন আর্থিক খাতে। পুলিশ বলছে, বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে যাওয়ায় অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। কারখানা মালিক ও বিজিএমইএর (বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি) নেতারা বলছেন, জ্বালানি সংকট নিরসন ও দ্রুত ব্যাংকের সহজ ঋণ সুবিধা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
নানা সংকটে বর্তমানে বন্ধ হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হওয়া গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী জরুন এলাকার কেয়া গ্রুপের একাধিক পোশাক কারখানা। এসব কারখানায় কাজ করতেন ১৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে এ কারখানাগুলোতে প্রথম মন্দার ধাক্কা লাগে ২০২৩ সালে। এরপর দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে কারখানাগুলোর একের পর এক ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। ঋণখেলাপির অভিযোগ এনে কারখানা মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়। মালিকপক্ষের কোনো আবেদনেই সাড়া দেয়নি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এতে শ্রমিক মজুরি, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিলসহ কারখানা পরিচালনার ব্যয় নির্বাহে তীব্র টানাপোড়েনে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। পরে শ্রমিকদের ঘন ঘন আন্দোলন, ভাঙচুরের ঘটনায় কারখানাগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
কেয়া গ্রুপের মালিকপক্ষের দাবি, ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে তাদের ঋণখেলাপি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু যে ফরেন কারেন্সি এসেছে, তা ডিপোজিট করা হয়নি (রপ্তানির বিপরীতে আসা বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা না করে ঋণের সঙ্গে সমন্বয় ব্যাংকের)। ফলে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকগুলো ফরেন কারেন্সি পুরোপুরি ডিপোজিট করলে কারখানা ঋণখেলাপি হতো না।
কেয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক পাঠান বলেন, ‘সাউথ ইস্ট ব্যাংক আমার ১ হাজার মিলিয়ন রিয়েলাইজ পেয়েছে; কিন্তু তারা আমার ফরেন কারেন্সিতে ছয়শ মিলিয়ন জমা করেছে এবং চারশ মিলিয়ন তারা ডিপোজিট করেনি, যার জন্য একটি প্রবলেম। পূবালী ব্যাংক দুইশ মিলিয়ন রিয়েলাইজ পেয়েছে; কিন্তু তারা ফরেন কারেন্সিতে কোনো ডিপোজিট করেনি। ন্যাশনাল ব্যাংক ৫৮ মিলিয়ন এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৬ মিলিয়ন ডিপোজিট করেনি। এ চারটি ব্যাংকে আমার ঋণ ২৬শ কোটি টাকা। তারা যদি ফরেন কারেন্সি ঢোকায় তবে সমস্যা থাকে না।’ এ ছাড়া গ্যাস সংকটে কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয় বলে জানান তিনি।
কারখানাগুলো বন্ধ ঘোষণা করায় কর্মহীন হয়ে পড়েন হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। একসময় দিন-রাতে সবসময়ই কর্মচাঞ্চল্যের এ প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎই যেন রূপ নেয় প্রাণহীন এক জড়বস্তুতে। কলকারখানা ও পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শিল্প পুলিশ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু কেয়া গ্রুপের পোশাক কারখানাগুলোই নয়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত গাজীপুরে নানা সংকটে ১০৬টি কলকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে নিজ নিজ কারখানা কর্তৃপক্ষ। এতে বেকার হয়েছেন ৭৮ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর ১৩টি এবং মাহমুদ জিন্স, ডার্ড কম্পোজিট, পলিকন লিমিটেড, টেক্সটিল ফ্যাশন, ক্লাসিক ফ্যাশন, লা-মুনি অ্যাপারেলস, টি আর জেড গার্মেন্টস, রোয়া ফ্যাশনন্সসহ বিজিএমইএর তালিকাভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠান।
এসব কারখানার হঠাৎই বেকার হয়ে পড়া বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের অনেকে নতুন কাজ না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। চাকরিহারা হয়ে কেউবা চালান অটোরিকশা, আবার কেউ কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনাসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। নারী পোশাক শ্রমিকদের মধ্যেও অনেকে দূরের অন্যকোনো পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছেন। আবার বহু শ্রমিক নতুন চাকরি না পেয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ টিকে থাকতে গাজীপুরে থেকেই টেইলারিং, কাপড়ের দোকানসহ নানা পেশায় যুক্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে গাজীপুরের শ্রমিকপল্লিতে চলছে হাহাকার। বন্ধ হওয়া টি আর জেড গার্মেন্টসের শ্রমিক সালেহা বেগম বলেন, ‘দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এ কারখানায় কাজ করছি। হঠাৎ কারখানা বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্টে আছি। নতুন করে কোনো কারখানায় যোগ দিতে পারি নাই। আগের মতো সুযোগ-সুবিধা না পেলে চাকরি করে কী হবে।’
এদিকে বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়া এবং বকেয়া বেতনের দাবিতে মাঝেমধ্যেই মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। তারা ভাঙচুর, যানবাহনে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটান। এতে প্রায়ই সড়ক-মহাসড়ক বন্ধ হয়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
শুধু শ্রমিকরা নন, কারখানা বন্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আশপাশের বিভিন্ন জনপদেও। কারখানা এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়ি ভাড়াসহ নানা ক্ষুদ্র পেশায় ধস নেমেছে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভাড়া বাসা বদল করে তুলনামূলক কম টাকায় অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়েছেন অনেকে।
কেয়া গ্রুপের কারখানার সামনে কথা হয় কয়েকজন দোকানির সঙ্গে। তারা বলেন, আগে দিনে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেচাকেনা হতো। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। জরুন এলাকার মুদি দোকানি রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আগে প্রতিদিন দোকানে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বিক্রি হতো, এখন তা ১ থেকে ২ হাজারে নেমে এসেছে। এলাকায় আগের মতো বেচাকেনা নেই।’
গাছা এলাকার একটি বাড়ির মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘একসময় বাসা ভাড়ার জন্য প্রতিদিন লোক আসত। এখন ভাড়াটিয়ার চাপ কমে গেছে। অনেকের বাসা খালিও থাকছে। এ অবস্থায় বাড়ি নির্মাণে বিরাট অঙ্কের বিনিয়োগের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
পরিস্থিতির উত্তরণে করণীয় সম্পর্কে বিজিএমইএ নেতারা ও পোশাক কারখানা মালিকরা বলছেন, জ্বালানি সংকট নিরসনের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও কারখানা চালুর বিষয়ে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে এসি শিল্প এস্টেট ও স্টাইলিশ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ব্যাংকের সহযোগিতা পাচ্ছেন না মালিকরা। ফলে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন, এতে বেকার হয়ে পড়েছেন শ্রমিকরা। অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন। এটা অর্থনীতির জন্য খারাপ খবর।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের গাজীপুরের সহকারী মহাপরিদর্শক (সাধারণ) মো. রবিউল ইসলাম বাঁধন জানান, দেশের পোশাক কারখানাগুলো বেশকিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। যদিও অধিদপ্তর কারখানা বন্ধের সঠিক কারণ নির্ণয় ও কারখানা চালু করতে করণীয় বিষয়ে কাজ করছে।
হঠাৎই একসঙ্গে বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ায় নতুন চাকরি না পেয়ে তাদের অনেকেই চুরি, ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে গাজীপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে, যা স্বীকার করেছেন মহানগর পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও।
মালিক-শ্রমিক ও শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ছোট-বড় ৫ হাজার কলকারখানা রয়েছে। যার মধ্যে ২ হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত। এর মধ্যে পোশাক কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ১৫৪টি।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার আল মামুন শিকদার বলেন, ‘মালিকানা পরিবর্তন, ব্যাংক ঋণ রিশিডিউল (পুনঃতপশিল) না করা, কাজ না থাকা ইত্যাদি কারণে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। তবে আর্থিক সংকটের কারণেই বন্ধ হচ্ছে বেশিরভাগ কারখানা।’
বেকারত্ব বাড়ায় অপরাধও বাড়ার কথা স্বীকার করেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর গাজীপুরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এখানকার শ্রমিকশ্রেণি, যারা পেটের ভাত বা খাবারের জোগান করতে পারেনি, তারা রাস্তায় বেরিয়ে ছিনতাই বা অন্য অপরাধে জড়িয়ে যায়। কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেলে যে কোনো জায়গায় অপরাধ বেড়ে যায়, এটা স্বাভাবিক। কারখানা বন্ধ হওয়াটাকে আমরা হুমকি মনে করছি। ৫ আগস্টের পর বেকার শ্রমিকদের একটি অংশ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়েছে।’
মন্তব্য করুন