বৃষ্টি এখনো থেমে থেমে নিয়মিত হচ্ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চলতি মৌসুমে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এখন ৬০ হাজার ছুঁইছুঁই। মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় আড়াইশ। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকতে পারে। সারা দেশেই রোগী শনাক্ত হচ্ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে মশার উপদ্রবে। তবে সবচেয়ে বেশি মশার উপদ্রব এবং মৃত্যু ঘটছে ঢাকা ও বরিশালে। দুই বিভাগে ডেঙ্গুতে প্রায় ৮০ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ দুই বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও প্রায় ৪৫ হাজার। দুই যুগ ধরে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সীমাবদ্ধ ছিল ঢাকায়; কিন্তু এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে বরিশালসহ অন্যত্রও। এই মুহূর্তে ডেঙ্গুর লাগাম টানতে না পারলে, সামনে ঢাকার মতো উচ্চ সংক্রমণ দেখা দিতে পারে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে
আক্রান্ত হয়েছেন ৫৯ হাজার ৮৪৯ জন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে শনাক্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ৭৪৮ জন, ঢাকা বিভাগে ৯ হাজার ৩৭৪, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৭ হাজার ৬০৯ এবং দক্ষিণে ৮ হাজার ৯২২ জন। দুই বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা মোট ৭৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। বাকি ২৫ দশমিক ৪০ শতাংশ রোগী ভর্তি হয়েছেন দেশের অন্যান্য বিভাগে। তার মধ্যে চট্টগ্রামে ৮ হাজার ৮৭৮ জন, রাজশাহীতে ৩ হাজার ৮১১, খুলনায় ৩ হাজার ৪২, ময়মনসিংহে ১ হাজার ৬৭৬, রংপুরে ৬০০ এবং সিলেটে ১৮৯ জন।
চলতি মৌসুমে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ডেঙ্গুজ্বরে মারা গেছেন ২৪৫ জন। এর মধ্যে বরিশালে ৩৬ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১২২, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩৩ এবং ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় তিনজন। ফলে ঢাকা ও বরিশালে মৃত্যুর হার ৭৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। বাকি ২০ দশমিক ৮২ শতাংশ মৃত্যু ঘটেছে দেশের অন্যান্য বিভাগে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ২৫ জন, রাজশাহীতে ১১, ময়মনসিংহে আট এবং খুলনায় সাতজন মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুই যুগ ধরে ডেঙ্গু ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। নিয়ন্ত্রণে চরম অবহেলার কারণে এটি এখন সারা দেশে বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ঢাকার পরে বরিশালেও উচ্চ সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এখনই মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে, দেশের সর্বত্র পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব চলবে। এজন্য প্রত্যেক নাগরিককে নিজের ঘর ও আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। নিজের ঘরের মশা নিজেকেই মারতে হবে। জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। ডেঙ্গু পরীক্ষায় ফল নেগেটিভ এলেও নিজেকে ডেঙ্গুরোগী ধরে নিয়েই চিকিৎসায় মনোযোগ দিতে হবে। নিজের সুরক্ষায় অবহেলা করা যাবে না। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠানের মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু চিকিৎসা দিয়ে জনবহুল দেশে ডেঙ্গু মোকাবিলা সম্ভব নয়। এজন্য একটি সমন্বিত গাইডলাইন তৈরি ও বাস্তবায়ন জরুরি। নগরের চেয়ে এখন গ্রামের ডেঙ্গু নিয়েই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ। এখনই নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে আগামী ৩০ থেকে ৪০ বছর এ রোগের ভোগান্তি পোহাতে হবে।’
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর সেপ্টেম্বরে সর্বাধিক ১৫ হাজার ৮৬৬ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫১ জন, জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪ এবং আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন।
অক্টোবরের গত ১৯ দিনে ভর্তি হন ১২ হাজার ৫০৭ জন এবং মারা গেছেন ৪৭ জন। সেপ্টেম্বরে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৭৬ জন। জুলাইয়ে মারা যান ৪১ জন, জানুয়ারিতে ১০, ফেব্রুয়ারিতে তিন, এপ্রিলে সাত, মে মাসে তিন, জুনে ১৯ এবং আগস্টে ৩৯ জন। মার্চে মৃত্যুর কোনো তথ্য দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সবশেষ তথ্যানুযায়ী, গতকাল ডেঙ্গুতে একজন মারা গেছে। এক দিনে ৯৫০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ৮৪৮ জন ছাড়পত্র পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত মোট ৫৬ হাজার ৮১১ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, তারা ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ রোগী ভর্তি হন এবং সর্বাধিক ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০২৪ সালে জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মারা যান ৫৭৫ জন।
মন্তব্য করুন