তেঁতুলিয়ার পঞ্চগড়ে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার মেয়ে তাহমিনা আখতার মোল্লা। একাত্তরের নভেম্বরে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার মুক্তাঞ্চলে এক রাজনীতি সচেতন পরিবারে তার জন্ম। বাবা ছিলেন তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাদের বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ভারত থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাড়িতে থাকতেন।
ছোটবেলা থেকেই বাবা ও বড় ভাইয়ের কাছে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেমের গল্প শুনেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করেই সমাজের অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ব্রত নেন তাহমিনা। সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করে শিক্ষা-সমাজ- রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পার করে দিয়েছেন জীবনের অনেকটা সময়। নিজের কথা ভাবার সময় হয়ে ওঠেনি তার। সমাজের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে রয়ে গেছেন চিরকুমারী।
তাহমিনা আখতার মোল্লার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি তেঁতুলিয়া স্কুলে। পরে রংপুরের পীরগাছায় ইটাকুমারী স্কুলে ভর্তি হন। সেখানেই ছাত্রনেতা আবুল কাশেম, আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক রাজ্জাক, জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে ইটাকুমারী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কমিটিতে যুক্ত হন। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সেতাবগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে সক্রিয়ভাবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন তিনি। ১৯৯১ সালে ঠাকুরগাঁও কলেজে ভর্তি হন। সেখানে ছাত্রলীগ কলেজ কমিটির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এরপর মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হন। ওই বছর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তিনি ঠাকুরগাঁও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, সাংবাদিক বেবী মওদুদ ও অপু উকিলের নির্দেশনায় তিনি যুব মহিলা লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
পড়াশোনা ও রাজনীতির পাশাপাশি তিনি ১৯৯১ সালে তিনি জীবন বীমা করপোরেশনে চাকরি নেন। বীমার ওপর ডিপ্লোমাও অর্জন করেন। ২০০৫ সালে রাজশাহী বিভাগের শ্রেষ্ঠ বীমা কর্মীর পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৮ সালে চাকরি ছেড়ে উপজেলা নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে জয়ী হন।
আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের আগ্রহে তিনি প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হন এবং ২০১০ সালে পাস করেন। ঢাকায় এসে আইন বিষয়ে পড়তে গিয়ে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবে ওই বছিরই তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে ল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ওই জেলায় তার উদ্যোগে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিএসএড (ব্যাচেলর ইন স্পেশাল এডুকেশন) কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়।
২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাহমিনা আখতারকে ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মেয়র পদে মনোনয়ন দেন। ওই নির্বাচনে পরাজিত হলেও ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী তাকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় মহিলা সংস্থার ঠাকুরগাঁও জেলার চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব দেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাহমিনা আখতার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে তাহমিনা আখতার মোল্লা কালবেলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও সবকিছু ঠিক থাকলে ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হতাম। ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষের প্রতি এই আস্থা আমার রয়েছে। কিন্তু শুরুতে আমার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছিল। আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে প্রার্থীতা ফিরে পাই ২৮ ডিসেম্বল কিন্তু সেদিন বৃহস্পতিবার হওয়ায় উচ্চ আদালতের আদেশের কপি পাই রোববার। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে সেটি জমা দিয়ে বিকেল সাড়ে ৪টার পর প্রতীক বরাদ্দ পাই। ফলে মাত্র চার দিনে সব ভোটারের কাছে গিয়ে ভোট চাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। অন্যায়ভাবে প্রার্থিতা বাতিল করে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা না হলে নির্বাচনের ফলাফল অবশ্যই অন্যরকম হতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঠাকুরগাঁওয়ে যিনি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান নেতা। সেইসঙ্গে বিত্তবানও। আমি নির্বাচনে অংশ না নিলে অনেকে হয়তো ভাবতেন, আমি অর্থের বিনিময়ে নির্বাচন থেকে সরে গেছি।’
দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে তাহমিনা আখতার মোল্লা সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন।
এ বিষয়ে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তাঞ্চলের মানুষের অন্যরকম মমত্ববোধ কাজ করে। এ কারণেই ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের মতো ডাকসাইটে নেতাও নির্বাচনে কখনো মুক্তাঞ্চলের ভোটারদের ভোট পাননি। সেই মুক্তাঞ্চলের মেয়েকে প্রধানমন্ত্রী যোগ্য মনে করলে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন দেবেন।’
সংসদে যাওয়ার সুযোগ পেলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন এবং মানুষের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন বলেও তাহমিনা আখতার মোল্লা প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।