যে কোনো উৎসবে এখন প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ফুল। বছরজুড়ে বাজারে পাওয়া যায় নানা প্রজাতির ফুল। চাহিদা থাকায় দুই-তিনটি জেলা থেকে এখন ফুলের আবাদ বিস্তৃত হয়েছে দেশের ২৪টি জেলায়। বসন্ত উৎসব, ভালোবাসার দিন আর বিদ্যার দেবীর আরাধনা—এই তিনে মিলে এবার ফুলের চাহিদা ছিল প্রচুর। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা মহামারির পর এ বছর আশানুরূপ ফুল বিক্রি করতে পেরেছেন তারা। শুধু রাজধানীতেই এক দিনে দেড়শ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। এবার রেকর্ডসংখ্যক ফুল বিকিকিনিতে খুশি প্রান্তিক কৃষক ও ব্যবসায়ীরাও। তবে বিদেশ থেকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে ফুল আনা বন্ধ হলে তারা আরও লাভবান হবেন বলে জানান।
এদিকে আকস্মিকভাবে ফুলের দাম বৃদ্ধি মেনে নিতে পারেননি ক্রেতারা। এবার অত্যধিক দামে গোলাপ বিক্রি হয়েছে। ফুলের জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হয়েছে ক্রেতাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিমন মাহমুদ বলেন, শাহবাগে ফুল কিনতে গিয়েছিলেন। সেখানে বিক্রেতা প্রথমে একটি বড় গোলাপের দাম ২০০ টাকা চেয়েছিলেন। দরকষাকষির পরে নিঝুম গোলাপটির দাম মাত্র ৩০ টাকা কমাতে পারেন। দাম কমাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি অন্য দোকান থেকে ৫০০ টাকায় চারটি মাঝারি আকারের গোলাপ কেনেন।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি ও ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি বাবুল প্রসাদ কালবেলাকে বলেন, ঢাকা শহরের শাহবাগ ও আগারগাঁওয়ে দুটি পাইকারি ফুলের বাজার রয়েছে। পহেলা ফাল্গুন, সরস্বতী পূজা এবং ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে পাইকারি বাজারে গত কয়েক দিনে অন্তত ৭৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। যার খুচরা বাজার ১৫০ কোটি টাকার মতো। এবার কৃষকরা লাভবান হয়েছেন, ভালো দাম পেয়েছেন তারা। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীদের আশানুরূপ মুনাফা হয়নি।
লিলিয়ামসহ কিছু ফুল বাংলাদেশে চাষ হয় না। সেসব ফুল ভারত থেকে আমদানি করা হয়। উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ এসব ফুল ব্যবহার করেন। ভারত থেকে আমদানি করা ফুলের পরিমাণ ২ শতাংশও হবে না। এতে কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। ফেব্রুয়ারি মাসে ৩০০ কোটি টাকার মতো ফুল বিক্রি হবে বলে আশা করছি। তবে এসএসসি পরীক্ষা শুরুর কারণে বাজারে প্রভাব পড়তে পারে। পরীক্ষার্থী রয়েছে এমন পরিবারের সদস্যরা হয়তো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কর্মসূচি এড়িয়ে চলবেন। মানুষের অংশগ্রহণ কম হলে ফুল বিক্রিও কম হবে। এতে ২০ শতাংশ ফুল কম বিক্রি হতে পারে। তার পরও প্রচুর ফুল বিক্রি হবে।
শাহবাগের আনিকা পুষ্প বিতানের স্বত্বাধিকারী ও শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, এবার ফুলের বেচাকেনা খুবই ভালো হয়েছে। এক দিনে তিনটি উপলক্ষ থাকলেও ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছি। এতে অনেক কষ্ট হয়েছে। করোনার পর এই প্রথম ফুলের প্রতি মানুষের টান দেখা গেল। শেষবেলায় যে ফুল ছিল তাও বিক্রি হয়েছে। বুধবার রাত ২টা পর্যন্ত ফুল বিক্রি হয়েছে।
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার পাড়াগাঁও এলাকায় ৯ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করেছেন জহির উদ্দিন বাবর। তিনি বলেন, এবার চাষিরা লাভবান হয়েছেন। শৈত্যপ্রবাহের সময় ফুলগাছে মড়ক দেখা দেয়। যে পরিমাণ ফুল উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। তবে বাজারমূল্য বেশি হওয়ায় সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছেন তারা। দেশে উৎপাদিত ও বিদেশ থেকে আমদানি করা ফুল দিয়ে দেশে বিদ্যমান ফুলের যে চাহিদা, তার সবটুকু পূরণ হয় না। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ভারত থেকে ফুল আনায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। অবৈধভাবে ফুল এনে ব্যবসায়ীরা কম দামে ফুল বিক্রি করেন। এতে বাজারে প্রভাব পড়ে। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভারত থেকে ফুল আনা হলে তাতে আমাদের চাষিদের ক্ষতির কিছু নেই।
ঢাকার পাইকারি ফুল ব্যবসায়ী ইমামুল হোসেন বলেন, পাইকারি বাজারে প্রথমদিকে ফুলের দাম খুবই বেশি ছিল। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তিন-চারগুণ দাম বেশি হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে একটি গোলাপ পাইকারি বাজারে ১০ থেকে ২৫ টাকায় পাওয়া যায়। তবে দিবস ঘিরে প্রতিটি ফুল ৪০ থেকে ৬০ টাকায় কিনতে হয়েছে। এবার চীন ও ভারত থেকে ফুল আমদানি করেছি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে সমস্যার কারণে একটি চালানে ধরা খেয়েছি। সময়মতো এলসি করতে না পারায় ৩-৪ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। ফুলের চালানটি আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) সকালে পৌঁছেছে।
আগারগাঁও পাইকারি ফুল বাজার সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন বলেন, এবার আমাদের পাইকারি বিক্রেতাদের মাথায় হাত। বিশেষ করে বাজারে ভারতীয় গোলাপ আসায় দেশি গোলাপের দাম পাইনি। বরং যে দামে কিনেছি তার থেকে কমে বিক্রি করতে হয়েছে। ১৩ লাখ টাকার ফুলের মধ্যে ৩ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারিনি। খুচরা দোকানে গোলাপের দাম পেলেও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এবারে ফুলের ব্যবসায় লাভ করতে পারেননি। অনেক ব্যবসায়ীরই প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ফুল অবিক্রীত রয়েছে।
আগারগাঁও পাইকারি ফুল বাজার সমিতি সূত্রে জানা গেছে, সেখানকার পাইকারি মার্কেটে এবার প্রায় ১০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। বাজারে মোট গোলাপের মধ্যে ৩৫ ভাগ ছিল ভারত থেকে আমদানি করা। পাইকারি দোকানে প্রতিটি ভারতীয় গোলাপ বিক্রি হয়েছে ৬০-৭০ টাকায়। এ ছাড়া দেশি চায়না গোলাপ প্রতিটি ৫০-৫৫ টাকা এবং দেশি গোলাপ ১৫-২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। ভারত থেকে প্রতিটি গোলাপ আনতে ব্যবসায়ীদের খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ টাকা। এ ছাড়া পাইকারি বিক্রেতাদের খামারিদের কাছ থেকে দেশি চায়না গোলাপ প্রতিটি ৪০-৫০ টাকা এবং দেশি গোলাপ প্রতিটি ১০-২০ টাকা দরে কিনতে হয়েছে।