সাগরের জলরাশি থেকে ভেসে আসছে একটি জাহাজ। জাহাজটি তীরের কিছুটা কাছাকাছি আসতেই চারদিকে শুরু হলো চিৎকার। জাহাজটি হাতের নাগালে ভিড়তেই তীরে থাকা স্বজনদের কারও কারও চোখে বেয়ে আসে জল, দীর্ঘদিন পর প্রিয় মুখটাকে দেখে কেউ কেউ বাধা ডিঙিয়ে হাত মেলাতে ছুটে যান জাহাজের কাছে। জাহাজ থেকে প্রিয় মানুষগুলো নেমে আসতেই জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। নাবিকদের চোখেও বেয়ে আসে নোনা জল। সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার ৬৫ দিন পর ‘এমভি জাহান মণিতে’ চড়ে যখন ২৩ নাবিক চট্টগ্রামে ফেরেন, তখন দৃশ্যটা ছিল এমনই।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৪টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল-১ (এনসিটি) নম্বর এসে পৌঁছান নাবিকরা। সেখানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নাবিকদের নিয়ে এক সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তাদের বরণ করতে উপস্থিত ছিলেন স্বজনরা। পাশাপাশি কেএসআরএমের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্য দিয়ে নাবিকদের স্বজন-পরিবারের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো।
গত ১২ মার্চ সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয় এমভি আব্দুল্লাহ। প্রায় ১ মাস পর গত ১৪ এপ্রিল ভোরে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হন ২৩ নাবিক। দীর্ঘদিন সেই জিম্মি দশায় অনেকটা ট্রমা বয়ে গেছে নাবিক ও স্বজনদের কাছে। ফিরে আসার দিনে তাই নাবিক ও তাদের পরিবার-স্বজনদের সেই দুঃস্বপ্নের যাত্রা ফুরাল। এখন নতুন করে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তারা।
এর আগে দুপুর থেকেই বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে স্বজনদের প্রতীক্ষা শেষের পালা শুরু হয়। নাবিকদের বরণ করে নিতে যারা এসেছিলেন, তাদেরই একজন এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমদের মা জোছনা বেগম। আগ্রাবাদ সিডিএ ১০ নম্বর থেকে ছেলেকে নিতে আসেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন তানভীরের স্ত্রী রাহা। ছেলেকে কাছে পেয়েই আপ্লুত হয়ে পড়েন জোছনা বেগম। তিনি বলেন, ‘আজ খুব আনন্দ লাগছে, যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। ছেলেটা যখন জলদস্যুদের কবলে পড়ে, তখন থেকে খুব টেনশনে ছিলাম। প্রতিটি দিন মনে হচ্ছিল এক যুগের মতো। কিন্তু সবার সহযোগিতায় আমার ছেলেকে বুকে ফিরে পেয়েছি। এর চেয়ে বেশি আনন্দের দিন আমার জীবনে আর আসেনি।’
এবার ঈদে বাবাকে কাছে পাননি জলদস্যুদের কবলে পড়া এমভি আব্দুল্লাহ চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের ছোট্ট দুই মেয়ে ইয়াশরা ফাতেমা ও উমাইজা মাহদিন। তাই বাবাকে কাছে পেয়ে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। বাবা আসার খবরে দুই হাতে এনেছিল ফুল। বাবাকে কাছে পেয়েই দৌড়ে গিয়ে চুমুতে ভরিয়ে দেয় গাল। বাবা আতিকুল্লাহও দুই কন্যাকে বুকে আগলে রাখেন কিছুক্ষণ। বাবা-মেয়ের এমন ভালোবাসায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন উপস্থিত অনেকেই।
এদিকে স্বজনদের কাছে ফিরলেও জলদস্যুদের কাছে বন্দিদশার ভয়ংকর স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে নাবিকদের। তাদের অনেকের কাছেই ফিরে আসার বিষয়টি যেন স্বপ্নের মতো। অনেকে ভাবেননি আবারও ফিরে আসবেন পরিবার-স্বজনদের কাছে। ভাবেননি আবারও প্রিয় শহরটাকে দেখা যাবে নিজ চোখে। তাই তো ফিরে আসার আনন্দটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিলেন না তারা।
বিভীষিকার সেই দিনগুলোর কথা জানতে চাইলে অনেকেই চাপা চাপা সুরে কথা বলেছেন। তুলে ধরেন ভয়ংকর দিনগুলোর কথা। অনেকেই এড়িয়ে গিয়ে বলেছেন ‘পাস্ট (অতীত) মনে করতে চাই না প্লিজ। এখন আনন্দের দিন।’
নাবিকরা জানান, বন্দিদশার শুরুর দিকে অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। এ সময় তারা জীবন নিয়ে ফিরতে পারা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। সবসময় একে-৪৭ রাইফেলসহ অনেক ভারী অস্ত্র নিয়ে পাহারা বসাত জলদস্যুরা। কৌশলগত কারণে নাবিকরা জলদস্যুদের সহায়তা করতেন, জলদস্যুরা যেমনটা বলতেন, তাই শুনতেন। তবে এত তাড়াতাড়ি যে তারা ফিরতে পারবেন, এটা কখনো ভাবেননি। অনেকের মনে মনে শঙ্কা ছিল এই যাত্রা হয়তো শেষ যাত্রা।
এদিকে এমভি জাহান মণিতে চড়ে চট্টগ্রামে ফিরেছেন নাবিকরা। সেখানে ঘটে গেল এক কাকতালীয় ঘটনা। ‘জাহান মণি’ নামটার সঙ্গেও যেন জড়িয়ে আছে জলদস্যুদের ইতিহাস। ১৪ বছর আগে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছিল এমভি জাহান মণি নামে একটি জাহাজ। কাকতালীয়ভাবে ওই জাহাজটিও ছিল দেশের স্বনামধন্য শিল্প গ্রুপ কেএসআরএমের। সেবার জাহাজের নাবিকরা ১০০ দিন জিম্মি থাকার পর মুক্তিপণের বিনিময়ে জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। এমভি আব্দুল্লাহও সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়ে ৩১ দিন ছিল। পরে জাহান মণি জাহাজটি স্ক্র্যাপ করে বিক্রি করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন আরও একটি লাইটারেজ (ছোট জাহাজ) জাহাজের নাম রাখা হয় জাহান মণি। সর্বশেষ ‘জাহান মণি’ নামে ছোট জাহাজটিতেই চট্টগ্রামে ফেরেন এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিক।
কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া সেই জাহান মণি অনেক আগেই স্ক্র্যাপ করে বিক্রি করে দেওয়া হয়; কিন্তু জাহান মণি নামটি নিয়ে আমাদের কোম্পানির দুর্বলতা রয়েছে। তাই সেই নামটি রেখে দেওয়ার জন্য একটি লাইটার জাহাজের নামকরণ করা হয়েছে জাহান মণি। আর এই জাহাজে করেই নাবিকরা এসেছেন।