জাফর ইকবাল 8
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০২:০৭ এএম
আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০৯:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে চলেছে সংঘবদ্ধ অপকর্ম

অনিয়ম
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে চলেছে সংঘবদ্ধ অপকর্ম

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাজ হলো দেশকে মাদকমুক্ত করা। তবে বিগত সরকারের আমলে নিজেই নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতো এই সংস্থা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা একটি বিশেষ বলয়ের সম্মতি ছাড়া কিছুই করার উপায় ছিল না। তাদের কথামতোই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে কর্মকর্তাদের প্রাইজ পোস্টিং, বদলি, নিয়োগ, অবৈধ সুবিধা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আটকে রাখা, রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন না দেওয়া, অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট প্রতিবেদন দেওয়া, খেয়াল-খুশিমতো বার লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন করাসহ সব রকম অনিয়ম চলত। বঙ্গবন্ধু পরিষদের শাখা খুলে দীর্ঘদিন ধরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে রাজত্ব করেছেন কয়েকজন কর্মকর্তা। প্রকাশ্যে এই সংগঠনের ভিন্ন দুটি কমিটি থাকলেও দুপক্ষের কয়েকজন নেতা মিলে গড়ে তুলেছিলেন আলাদা একটি সিন্ডিকেট। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে মূলত এই সিন্ডিকেটই ছিল সর্বেসর্বা। মাদক ব্যবসায়ীদের টাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের নিয়ে পিকনিক করার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পেত না। কেউ মুখ খুললেই তাকে জামায়াত-শিবিরসহ নানা ট্যাগ দিয়ে বদলি করানোসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হতো। আর যারা তাদের সঙ্গে সখ্য করে চলতেন, তাদের দেওয়া হতো প্রাইস পোস্টিং। এরপর নিয়মিত মাসোহারা নিতেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা। এ ছাড়া পোস্টিংয়ের সময়ও নেওয়া হতো এককালীন মোটা অঙ্কের টাকা।

জানা গেছে, যেসব এলাকায় মাদক ও মাদকসেবী এবং মাদক কারবারি বেশি, মদের বার বেশি—সেসব এলাকায় মাদকের কর্মকর্তাদের অবৈধ আয় বেশি হয়। তাই ওই এলাকায় পদায়ন হওয়াকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ ভাষায় ‘প্রাইস পোস্টিং’ বলা হয়।

জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে নিয়োগ দেওয়া হতো সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পাঠানো তালিকা অনুযায়ী। প্রতিটি নিয়োগের জন্য ৫ থেকে ১০ লাখ করে নিয়ে সেই টাকা বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা পৌঁছে দিয়ে আসতেন মন্ত্রীর ফার্মগেটের বাসায়। এ ছাড়া কর্মকর্তারা তাদের অবৈধ আয় থেকেও নিয়মিত মাসোহারা দিতেন মন্ত্রীকে। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ৫ সদস্যের একটি দল ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে এই চক্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের একটি কমিটির সহসভাপতি ও উপপরিচালক (ঢাকা উত্তর) আবুল হোসেন, সহসভাপতি উপপরিচালক মো. বজলুর রহমান, প্রচার সম্পাদক ও সহকারী পরিচালক শিরিন আক্তার। তাদের সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের আরেক কমিটির সভাপতি ও উপপরিচালক (ঢাকা-গোয়েন্দা) রবিউল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক ও উপপরিচালক হামিমুর রশিদ, সহসভাপতি ও উপপরিচালক মো. মেহেদী হাসান।

অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদের নামে একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন বদলি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই সিন্ডিকেটের বাইরে কোনো বদলির প্রক্রিয়া শুরু হলে তারা আগেভাগেই ফাঁস করে দিত, যাতে সংশ্লিষ্ট লোকজন তদবির করে পোস্টিং টিকিয়ে রাখতে পারে। তাদের বিরুদ্ধে কারও প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না। কেউ কথা বললেই তাকে বিভিন্নভাবে হয়রারি করা হতো।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছ, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি ও উপপরিচালক (ঢাকা উত্তর) আবুল হোসেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আমুর হোসেন আমুর এলাকার লোক হওয়ায় তার সঙ্গে রয়েছে গভীর সখ্য। তালিকায় নিচে থেকেও আমির হেসেন আমুর সুপারিশে ই আবুল হোসেন উপপরিচালক থেকে অতিরিক্ত পরিচালকের পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে তাকে ফের উপপরিচালক পদে ফেরত পাঠানোয়। আবুল হোসেন সর্বশেষ রাজধানীতে মাদকদ্রব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ ঢাকা মেট্রো উত্তরের উপপরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। ঢাকা উত্তরের অধীনে মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে রয়েছে একাধিক বিহারি ক্যাম্প। আবুল হোসেনকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে এসব ক্যাম্পে মাদকের কারবার চলেছে। কয়েকটি ক্যাম্পে প্রকাশ্যে সিরিয়াল দিয়ে মাদক বিক্রির অন্তত ডজনখানেক ভিডিও রয়েছে কালবেলার হাতে।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ঢাকা গোয়েন্দা) মো. রবিউল ইসলাম চাকরিজীবনের বেশিরভাগ সময়েই কাটিয়েছেন রাজধানীতে। এই কর্মকর্তা সবচেয়ে বেপরোয়া ছিলেন মানিকগঞ্জের মোহাম্মদ আতোয়ার রহমান যখন মাদকের ডিজি ছিলেন। তখন ঢাকা মেট্রো উত্তরে ডিডি ছিলেন রবিউল। একই এলাকার হওয়ার সুবাদে এই কর্মকর্তা তখন ডিজির প্রভাব খাটিয়ে পোস্টিং বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময় তিনি প্রধান কার্যালয়ে গেলে সবাই আতঙ্কে থাকতেন। যেদিন রবিউল সদর দপ্তরে যেতেন সেদিনই কোনো না কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করা হতো।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের দ্বিতীয় কমিটির সহসভাপতি ও উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. মেহেদী হাসানের চাকরি জীবনের শুরুতেই সহকারী পরিচালক (গবেষণা ও প্রকাশনা) পদ থাকলেও তিনি বিধিবহির্ভূতভাবে অফিস করতেন সহকারী পরিচালক (লাইসেন্স) পদে। সদর দপ্তরে বসে সারা দেশের মদের বারের লাইসেন্স দিতেন তিনি। প্রতিটি লাইসেন্সের জন্য নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। পরবর্তী সময়ে খন্দকার রাকিবুর রহমান মাদকের ডিজি হলে জড়িয়ে পড়েন বদলি বাণিজ্যে।

এ ছাড়া একটি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপপরিচালক মো. হামিমুর রশীদ তার চাকরি জীবনের প্রায় ৯ বছর কাটিয়েছেন সদর দপ্তরে। রাজধানীর মদের বার এবং মাদক কারবারিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন হামিমুর। এ কারণে তিনি সব ডিজির প্রিয়ভাজন হয়ে টানা ৯ বছর চাকরি করেছেন সদর দপ্তরে। পরবর্তী সময়ে তিনি প্রাইস পোস্টিং নিয়ে মানিকগঞ্জে যান। সর্বশেষ এই কর্মকর্তা পটুয়াখালীতে ছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু পরিষদের নামে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটে ছিলেন একজন ঊর্ধ্বতনসহ আরও কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তারা রাসায়নিক পরীক্ষার ভুল প্রতিবেদন দেওয়া, বদলি, প্রাইস পোস্টিংসহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া সাধারণ মানুষকে মাদক দিয়ে ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। রাজধানীর বিভিন্ন মদের বার ও শিশা লাউঞ্জ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিতেন তারা। এসব অভিযোগে একাধিকবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তারা বঙ্গবন্ধু পরিষদের দোহাই দিয়ে বারবার দায়মুক্তি পেয়েছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে অভিযুক্তরা প্রত্যেকেই সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে কে বা কারা এবং কীভাবে কমিটি গঠন করেছে, তাও অবগত নন বলে জানিয়েছেন তারা।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘কেউ অপরাধ করলে ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। সবার বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১৬ বছর বয়সী কিশোরের ইতিহাস গড়া ম্যাচে লিভারপুলের শ্বাসরুদ্ধকর জয়

রুমিন ফারহানাকে নিয়ে অজানা গল্প বললেন আরজে কিবরিয়া

গাঁজা নিয়ে কারাগারে প্রবেশকালে কর্মচারী আটক

ডাকসুর প্রচারণায় মানতে হবে যেসব আচরণবিধি

চাকসু নির্বাচনে প্রক্টর ও রেজিস্ট্রারের অব্যহতি চেয়েছে ছাত্রদল

চমক রেখে দল ঘোষণা করল ব্রাজিল

৯ সংকেতে বুঝবেন টেস্টোস্টেরন হরমোন কমেছে

ইসরায়েলকে একহাত নিল ফ্রান্স-জার্মানি

দেশের চার এলাকাকে ‘অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন’ ঘোষণা

মাঝরাতে মিথিলার খুশির খবর

১০

‘ডিপার্টমেন্ট অব ওয়ার’ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

১১

সাব ব্রাঞ্চ ইনচার্জ পদে ইউসিবি ব্যাংকে চাকরির সুযোগ

১২

রাজধানীতে আজ কোথায় কোন কর্মসূচি

১৩

এসএমসিতে চাকরির সুযোগ, আজই আবেদন করুন

১৪

সিদ্ধিরগঞ্জে বিস্ফোরণে নাতির পর নানির মৃত্যু

১৫

ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলন আজ

১৬

আজ ঢাকার আবহাওয়া কেমন থাকবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

১৭

২৬ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৮

ডাকসু নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু আজ

১৯

তিন সহযোগীসহ ‘মাদক সম্রাট’ শাওন গ্রেপ্তার

২০
X