বিরল ও দুর্লভ পাখির খোঁজে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের টাওয়ারে বসে আছি ভোরের আলো ফোটার আগে থেকে। এ সময়টায় (জানুয়ারির শেষ থেকে মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত) টাওয়ারের পাশের মান্দারগাছের (Indian Coral Tree) টকটকে লাল ফুলের রস পান ও পাপড়ি খাওয়ার জন্য নানা প্রজাতির পাখি আসে। মাঝেমধ্যে দুর্লভ ও বিরল পাখিরও দেখা মেলে।
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে এলো ফিঙ্গে পণ্ডিত (Hair-crested Drongo)। বেশিরভাগ সময় আমি এ পাখিটিকেই সর্বপ্রথম মান্দারের রস পান করার জন্য আসতে দেখেছি। ফিঙ্গে পণ্ডিত চলে যাওয়ার পর এলো লটকন টিয়ে (Vernal Hanging Parrot), মদনা টিয়ে (Red-breasted Parakeet), সোনাকপালী হরবোলা (Golden-fronted Leafbird) ও কইরিদি টিয়া (Blossom-headed Parakeet)। এরপর একে একে এলো কালোমাথা বুলবুলি (Black-headed Bulbul), সিঁদুরে মৌটুসি (Crimson Sunbird), ছোট মাকড়শাভুক (Little Spiderhunter), ছোট হলদে-ঝুঁটি কাঠঠোকরা (Lesser Yellow-naped Woodpecker) ও লম্বা লেজের বড় পাখি সবুজ বনকোকিল (Green-billed Malkoha)। ওদের ছবি তুলতে তুলতে এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট কাটালাম। পরের ২৮ মিনিট মান্দারগাছ বা তার আশপাশের কোনো গাছে কোনো পাখির দেখা মিলল না। দুর্লভ ও বিরল পাখি তো দূরের কথা।
ঠিক ৭টা ২৯ মিনিটে কপালের ওপর সুন্দর একটি ঝুঁটিসহ কালচে-ধূসর রঙের একটি পাখি এসে মান্দার ফুলের ওপর দাঁড়াল। পাখিটির সঙ্গে সেই ছেলেবেলা থেকেই আমার পরিচয়। অতি সাধারণ এক পাখি। কিন্তু মান্দারের টকটকে লাল ফুলের ওপর দাঁড়ানো হলুদ পা ও কালচে-ধূসর দেহের পাখিটিকে বেশ সুন্দর লাগছিল। সাধারণ পাখি দেখে প্রথমে ছবি তুলিনি। পরে একটি ক্লিক করেছিলাম মাত্র। ২০২২ সালের ১১ মার্চের ঘটনা এটি। মান্দার ফুলের ওপর এই পাখিটির প্রথম ছবিটি তুলেছিলাম ২০১৮ সালের ৬ মার্চ।
মান্দারের টকটকে লাল ফুলের ওপর দাঁড়ানো কালচ-ধূসর দেহের এই পাখিটি এ দেশের বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি ঝুঁটি শালিক। জংলি শালিক নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Jungle Myna. গোত্র স্টুরনিডি (Sturnidae), বৈজ্ঞানিক নাম Acridotheres fuscus (অ্যাক্রিডোথেরেস ফুসকাস)। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাখিটির দেখা মেলে।
ঝুঁটি শালিকের দেহের দৈর্ঘ্য ২৩ সেন্টিমিটার ও ওজন ৮৫ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির কপালের চমৎকার ঝুঁটিসহ মাথা ও ঘাড় কালচে-ধূসর। লেজ, পিঠ ও বুক মাঝারি ধূসর। দেহের নিচটা কালচে-গোলাপি। লেজতল-ঢাকনি ও ডানার প্রান্ত সাদা। ঠোঁট বা চঞ্চু কমলা-হলুদ, তবে নাসারন্দ্রসহ চঞ্চুর গোড়া কালচে-ধূসর। চোখ চকচকে হলুদ, চোখের চারদিকের কিছুটা অংশ পালকহীন। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। নখ বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল, চঞ্চু হলদে ও ঝুঁটি অপেক্ষাকৃত ছোট।
সারা দেশজুড়ে পাখিটির দেখা মেলে। এরা সাধারণত গ্রাম, চষা জমি, মুক্ত বনভূমি, বনের প্রান্ত প্রভৃতি জায়গায় বিচরণ করে। সচরাচর দলে থাকে। বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়, কেঁচো ও ফল খায়। গোধুলিতে অন্য প্রজাতির শালিকের সঙ্গে দলবেঁধে কোলাহল করে। বড় ঝাঁকে বাঁশবন, নলবন, আখক্ষেত বা অন্যান্য জায়গায় রাত কাটায়।
ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই প্রজননকাল। এরা সচরাচর আজীবনের জন্য জোড় বাঁধে। গাছের প্রাকৃতিক কোটর, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ব্রিজ বা দালানের ফাঁকফোকরে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩ থেকে ৭টি, রং নীলচে। ডিম ফোটে ১৫ থেকে ২১ দিনে। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে ডিমে তা দেয় ও ছানাদের যত্ন করে। ছানারা ১৮ থেকে ২০ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল প্রায় ৮ বছর।
ময়না ও শালিকের মতো এদেরও কথা বলার ক্ষমতা রয়েছে। ছোট ছানা এনে পুষলে ভালো পোষও মানে। তাই তো গ্রামগঞ্জে অনেকেই ঝুঁটি শালিকের ছানা এনে পুষে ও কথা বলা শেখায়। আমি বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পোষা ও কথা বলা ঝুঁটি শালিক দেখেছি। তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, এ দেশে সব ধরনের বুনো পাখি পোষা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কাজেই এদের পোষা যাবে না। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
লেখক: পাখি, বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর।