নামে ‘প্রধান বিরোধী দল’ হলেও গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের ইশারায় চলেছে জাতীয় পার্টির সব কার্যক্রম। দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল বয়কট করলেও বিগত তিনটি নির্বাচনেই অংশ নিয়েছে এক সময়ের স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল। তাও নিজেদের মতো নয়, ‘প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও আসন পাওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অনুগ্রহই ছিল তাদের একমাত্র অবলম্বন। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে পূর্বনির্ধারিত সংখ্যক আসনে জেতার পর বিরোধী দলের আসনে বসার এমন নজির সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। শুধু নির্বাচন নয়, জাতীয় পার্টি এ সময়ে সব ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল হয়েছিল। এমনকি দলীয় কোন্দল কিংবা পারিবারিক সমস্যা মেটাতেও দলটির শীর্ষ নেতারা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শরণাপন্ন হতেন। নামে বিরোধী দল হলেও জনসম্পৃক্ত কোনো ইস্যুতে কখনো রাজপথে নামতে দেখা যায়নি তাদের। কোনো কোনো বিষয়ে সংসদে গরম বক্তৃতা দিলেও সরকারের সবরকম বিতর্কিত কাজেই সায় ছিল দলটির। সংসদে বিল পাসের সময় জাপা এমপিরা হয় পক্ষে ভোট দিতেন অথবা ভোটদানে বিরত থাকতেন। এসব কারণে একসময় দেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে পরিচিত জাপা ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের মতোই কোণঠাসা অবস্থা জাতীয় পার্টির। দুর্বল সাংগঠনিক ভিত্তি, নেতাদের সুবিধাবাদী প্রবণতা এবং কোন্দলের কারণে এ দলটি নিশ্চিহ্ন হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারি কালবেলাকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি সরকারে থেকে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে চেয়েছে। সাধারণ মানুষ এটি মোটেও গ্রহণ করেনি। তাদের কাছে মানুষের তেমন কোনো প্রত্যাশাও নেই। তারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তাদের কথা ও কাজের কোনো মূল্য নেই। এ দলটি ধীরে ধীরে নামসর্বস্ব দলে পরিণত হবে।’
২০০৮ সাল থেকে নিজেদের শক্তির পরিবর্তে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে গাঁটছড়া বাঁধে দলটি। এতে জাপার কিছু নেতা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দল ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা বারবার আওয়ামী লীগের সঙ্গ ছেড়ে এককভাবে পথ চলতে কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন। এতে শীর্ষ নেতাদের কাছে বিরাগভাজন হয়েছেন কেউ কেউ। দলের সমালোচনা করায় বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে।
খোদ জাতীয় পার্টির অনেক নেতা মনে করেন, শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের ওপর এতটাই নির্ভরশীল ছিলেন যে, গত ১৫ বছর তারা জনগণের সমস্যা নিয়ে রাজপথে কোনো কর্মসূচি দেননি। এতে জনবিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। দিন দিন কমেছে কর্মী-সমর্থক ও রাজনৈতিক শক্তি। সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাস হারিয়েছে দলটি। এ কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাপা নেতাদেরও গা ঢাকা দিতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিলেও প্রকাশ্য কোনো কর্মসূচি দেওয়ার ভরসা পাচ্ছেন না নেতারা।
বিশ্লেষকদের মতে, একটি রাজনৈতিক দলের কাছে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া থাকা স্বাভাবিক। তা ছাড়া টানা তিন মেয়াদে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছে মানুষের চাওয়া খুব বেশি থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অথচ গত তিন মেয়াদে কখনো মানুষের পক্ষে রাস্তায় দাঁড়ায়নি জাতীয় পার্টি। শুধু তাই নয়, মাঠপর্যায়ে দলীয় কার্যক্রমও চোখে পড়েনি। রাজনৈতিক দল হিসেবে মানুষের কাছে যাওয়ায় কোনো প্রস্তুতি, পরিকল্পনা বা প্রচেষ্টাও ছিল না। সংসদে গরম বক্তৃতা আর ঢাকায় নির্ধারিত কয়েকটি মিলনায়তনেই সীমাবদ্ধ ছিল জাতীয় পার্টির রাজনীতি।
অনেকের মতে, গত তিনটি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের দোসরের ভূমিকায় ছিল জাতীয় পার্টি। দেশের অধিকাংশ দল বয়কট করলেও নানা নাটকীয়তা তৈরি করে শেষ পর্যন্ত ভোটে গেছে জাতীয় পার্টি। প্রতিবারই সমঝোতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন বাগিয়ে নেওয়াই ছিল তার মূল লক্ষ্য। নামে বিরোধী দল হলেও জাপার আসনে ক্ষমতাসীনরা কোনো প্রার্থী দেয়নি। এমনকি ভোট করার জন্য জাপা নেতারা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলেও আলোচনা আছে।
প্রতিটি নির্বাচনের পরই সংসদে ‘প্রধান বিরোধী দল’ হয়েছে জাতীয় পার্টি। এক্ষেত্রে দলটির নেতাদের পেছনে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে। মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছিলেন এরশাদ। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরকে করা হয়েছিল বিরোধীদলীয় নেতা। এ ছাড়া জাপা নেতাদের অনেকে বিরোধীদলীয় নেতা, হুইপ ও সংসদ সদস্য হিসেবে সুবিধা পেয়েছেন; কিন্তু মানুষের কোনো প্রত্যাশাই পূরণ করতে পারেননি তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত সাড়ে ১৫ বছর গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগের বিতর্কিত কোনো কাজেই দলটি রাজনৈতিকভাবে শক্ত কোনো অবস্থান নেয়নি। জাপা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে বিগত সরকার একতরফাভাবে বিতর্কিত অনেক সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করত। বাস্তবে জাপা তা করতে পারেনি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ঘুষ, খুন, গুম, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অর্থ পাচার, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, অনিয়ম, দুর্নীতি, দখল, বাকস্বাধীনতা হরণসহ জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে দলটি। সাইবার নিরাপত্তা বিল, নির্বাচন কমিশন আইন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে নানা বিতর্ক হলেও কার্যকর ভূমিকা নেয়নি জাপা। কোনো কোনো সময় লোক দেখানো বিরোধিতা করলেও সংসদে আইন পাসের সময় হয় পক্ষে ভোট দিয়েছে অথবা নীরব থেকেছে। দু-একটি ক্ষেত্রে ওয়াকআউট করার নজির থাকলেও তা লোক দেখানো বলে অনেকে মনে করেন।
সংসদ তো বটেই—নিজেদের দল চালাতেও পুরোপুরি সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে ছিল জাতীয় পার্টি। দলীয় কোন্দল থেকে শুরু করে এরশাদ পরিবারের দাম্পত্য কলহ মেটানোর জন্যও শেখ হাসিনার শরণাপন্ন হতে দেখা গেছে।
জাপার বিভিন্ন ধারার অনেক নেতার মূল্যায়ন, দলটি কখনো জাতীয় রাজনীতি করেনি। দলে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। শীর্ষ নেতারা ব্যক্তিগত স্বার্থের বিনিময়ে যাকে তাকে দলীয় পদ কিংবা নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছেন। চেয়ারম্যান যখন যাকে খুশি বহিষ্কার করেছেন, আবার তা তুলেও নিয়েছেন। এসব প্রবণতার কারণে জাপা কখনো গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করতে পারেনি। জনবান্ধব কর্মসূচি না থাকায় মানুষের আস্থা হারিয়েছে।
জাপার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বর্তমানে রওশনপন্থি অংশের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ কালবেলাকে বলেন, ‘কাজের সঙ্গে কথার কোনো মিল না থাকায় জাতীয় পার্টি সম্ভাবনাময় এবং গণমানুষের দল হতে পারেনি। জাপার বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কথা ও কাজে কোনো মিল নেই। তিনি পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ কেন্দ্রীয় নেতা ও তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে দল পরিচালনাসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মূলত সঠিক নীতির অভাবে জাপা মানুষের আস্থা হারিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দিনের পর দিন দলে ভাঙা-গড়ার খেলা চলছে। এ কারণে জাপা জনতার কাতার ও মানুষের মন থেকে সরে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ দলটির প্রতি একেবারেই আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। কোনোভাবেই তা পুনরুদ্ধার করা যাচ্ছে না।’
যদিও জি এম কাদেরপন্থিরা এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন। জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার কালবেলাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক চাপে স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে পারেনি জাতীয় পার্টি। মূলত এ কারণেই হয়তো সাধারণ মানুষ মনে করতে পারে, তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।’
জাপার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, জাতীয় রাজনীতি নিয়ে জাতীয় পার্টি কখনই কাজ করেনি। মূলত পরনির্ভরশীল হওয়ার কারণে দলটি কখনই নিজস্ব রাজনীতি গড়ে তুলতে পারেনি। তবে জনকল্যাণে কাজ করলে দেশ ও মানুষের কাছে জাতীয় পার্টি ফের ফিরতে পারবে বলেও আশা করেন তিনি।
রাজনৈতিক নানা বাস্তবতায় জাতীয় পার্টি স্বাধীনভাবে রাজনীতি করার সুযোগ না পাওয়ায় প্রত্যাশা অনুযায়ী মানুষের কাছে যেতে পারেনি বলে মনে করেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘১৯৯০ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আমাদের জোর করে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কাজ করিয়েছে। করতে হয়েছে। তারা আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে। পুরোপুরি প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে জনগণ আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।’
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে জাপার মূল প্রতিপক্ষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেভাবে জনগণ খুশি হয় সামনের দিনে আমরা এ বিষয়টি মাথায় রেখে রাজনীতি করব। আমরা মানুষের প্রয়োজনে প্রত্যাশা বিবেচনায় রাজনীতি করেছি, ভবিষ্যতে মানুষের পাশে থাকব।’