তৈরি পোশাক খাতের অস্থিরতা কাটছেই না। বেতন বৃদ্ধিসহ নানা দাবিতে প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। শ্রমিক অসন্তোষের জেরে গতকাল বৃহস্পতিবারও ২৫৭টি পোশাক কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১৯টি কারখানা বন্ধ রয়েছে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে। বন্ধ বাকি ৩৮টি কারখানা গাজীপুরের। এ ছাড়া শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে গাজীপুরের একটি ওষুধ কারখানাও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
গতকাল বন্ধ থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে ৯৪টি কারখানা শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় বন্ধ রয়েছে। ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ অর্থাৎ কাজ নেই তো মজুরিও নেই ধারায় বন্ধ হওয়া কারখানাগুলো যতদিন বন্ধ থাকবে, ততদিনের মজুরি পাবেন না শ্রমিকরা। আর বাকি ১৬৩টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকের তুলনায় পুরুষ বেশি নিয়োগ দিতে হবে। প্রধান এ দাবিসহ আরও কিছু দাবিতে দুই সপ্তাহজুড়ে অসন্তোষ চলছে, পোশাক কারখানা বেশি রয়েছে এমন শিল্পাঞ্চলগুলোতে। সাধারণত পোশাক কারখানায় পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। তবে গত কয়েক বছরে নারী শ্রমিকের হার অনেক কমেছে।
বর্তমানে আশুলিয়া ও গাজীপুর ছাড়া দেশের আর কোথাও শ্রমিক অসন্তোষ নেই। নিয়মিত রপ্তানি কার্যক্রমে রয়েছে দেশে এ ধরনের পোশাক কারখানা আছে ২ হাজার ১৪৪টি। অর্থাৎ বাকি ১ হাজার ৮৮৭টি কারখানা খোলা রয়েছে।
সাভার প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, সাভারের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে গতকালও ২১৯টি কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সাভার-আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ কারখানায় কাজে যোগ দিতে দেখা গেছে শ্রমিকদের। শিল্পাঞ্চলের কোথাও কোনো সড়ক অবরোধসহ কারখানায় হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। তবে আগে থেকেই কিছু কারখানায় অভ্যন্তরীণ বেশকিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ চলছিল। সেসব কারখানার শ্রমিকরা গতকাল কাজে ফেরেননি। এ ছাড়া বেশকিছু কারখানার শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পর কর্মবিরতিসহ কারখানা থেকে বের হয়ে গেলে সব মিলিয়ে শিল্পাঞ্চলের ২১৯টি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে শ্রম আইনের ১৩(১) ধারা অনুযায়ী বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ৮৬টি কারখানা আর বাকি ১৩৩টি কারখানায় আজকের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, শিল্পাঞ্চলে যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কারখানাগুলোর সামনে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য। এ ছাড়া শিল্পাঞ্চলে যৌথবাহিনীর টহল অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে, গাজীপুর প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুরে টানা শ্রমিক অসন্তোষ ও বিক্ষোভের জেরে আটটি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে ৩০টি পোশাক কারখানায়। এ ছাড়া শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে একটি ওষুধ কারখানা। বেতন বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনের মুখে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী এলাকার কাইকপাড়ায় অবস্থিত দি হোয়াইট হর্স ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
শ্রম পুলিশ ও কারখানা সূত্রে জানা গেছে, বেতন বাড়ানো, বার্ষিক ছুটি প্রদান, বিনা অজুহাতে চাকরিচ্যুত না করা, মেডিকেল ও মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া, দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা, শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস দেওয়াসহ ৫ দফা দাবিতে ওই কারখানার শ্রমিকরা গতকাল কারখানার ভেতরে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে এসে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই কারখানা বন্ধের নোটিশ দেখতে পান। এতে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানার গেটে অবস্থান নিয়ে কারখানা খুলে দেওয়ার দাবি জানান।
এদিকে, বাইরের প্রতিযোগী দেশের ইন্ধন ও ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে পোশাক শিল্পকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। গতকাল গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে সচিব বলেন, গত ৫ আগস্টের পর বহু শিল্প মালিক দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। এ কারণে সেসব ফ্যাক্টরিতে বেতন পরিশোধ হচ্ছে না। যে কারণে অসন্তোষ থামছে না। শ্রমিক কখনো তার কর্মস্থলে আগুন দিতে পারে না, বাইরের অপশক্তিতে এসব হচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্যের কথা উল্লেখ করে এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, স্থানীয়ভাবে ঝুট ব্যবসার দ্বন্দ্বে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ব্যবহার করা হচ্ছে, এ কারণে শিল্পনগরীতে অসন্তোষ কাটছে না।
তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশ শ্রমিক অধিকার ১০০-তে ১০০ নিশ্চিত করতে পারেনি। আমাদের এখানে রাতারাতি সব সমস্যা সমাধান সম্ভব না। শ্রমিকদের অনেক দাবি যৌক্তিক, মালিকরা চাইলে পূরণ করতে পারেন। আবার কিছু দাবি এখনই বাস্তবায়ন যৌক্তিক না। ন্যূনতম মজুরি এখনই দ্বিগুণ করার দাবি বাস্তবসম্মত কি না, সেটাই আমার প্রশ্ন। তিনি বলেন, শিল্প মালিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়নি। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সংকট নিরসনে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশ ও কারখানা মালিক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা। বিক্ষোভের জেরে অনেক সময় কারখানায় ভাঙচুর, কারখানার কর্মকর্তাদের মারধরসহ বিভিন্ন অস্থিতিশীল কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। আর এ সুযোগে কিছু বহিরাগত কারাখানায় লুটপাট বা অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এতে কারখানা কর্তৃপক্ষকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বা ঝামেলা হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে কারাখাগুলোর কোনোটিতে সাধারণ ছুটি বা কোনোটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জানা গেছে, আগস্টের বেতন পরিশোধ হয়েছে ৭৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ কারখানায়। মোট ১ হাজার ৫৯৫টি কারখানা মজুরি পরিশোধ করেছে। এখনো বাকি ২৫ দশমিক ৬১ শতাংশ কারখানা, অর্থাৎ ৫৪৯ কারখানায় আগস্টের মজুরি পরিশোধ হয়নি। শ্রম আইন অনুযায়ী, মজুরিকাল শেষ হওয়ার পর পরবর্তী মাসের প্রথম সাত কর্মদিবসের মধ্যে মজুরি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।