ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের মতো কোম্পানির নাম ও লোগো ব্যবহার করে এতে চাকরি দেওয়ার নাম করে বাংলাদেশ থেকে শতকোটি টাকা হাতিয়েছে একটি চীনা প্রতারক চক্র। চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে এ প্রতারণা করেছে চক্রটি। পরে প্রতারণার টাকা হুন্ডিতে পাচার করা হয়েছে। তাদের সহায়তা করেছে বাংলাদেশি একটি চক্র।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ প্রতারক চক্রের দুই চীনা নাগরিক ঝ্যাং পিং, ঝ্যাং ইরউয়া এবং বাংলাদেশি সিয়াম চৌধুরী ও আবীর হোসেনকে গ্রেপ্তারের পর এই তথ্য বেরিয়ে আসে। রাজধানীর রমনা থানায় প্রতারণার শিকার এক ব্যক্তির করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে ডিবি এই অভিযান চালায়।
ডিবির সাইবার বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, অ্যামাজন, ফেসবুক, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি ইউআরএল তৈরি করে বাংলাদেশে এ প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়েছিল। এরপর মাত্র সাড়ে চার মাসের ব্যবধানে হাতিয়ে নেওয়া হয় শতকোটি টাকা। এর সিংহভাগই হুন্ডির মাধ্যমে চীনে পাচার হয়েছে। সাবেক একজন অতিরিক্ত সচিবও এই চক্রের খপ্পরে পড়ে খুইয়েছেন লাখ লাখ টাকা।
সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের ফিন্যান্সিয়াল ও সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের প্রধান এডিসি সাইফুর রহমান আজাদ কালবেলাকে বলেন, প্রতারকরা চীনে বসে অ্যামাজন ইউআরএলের কাছাকাছি অনেক ওয়েবসাইটের ডোমেইন কিনে রেখেছে। যেগুলো ব্যবহার করে প্রতারণার ফাঁদ পাতে বাংলাদেশে। amazon99s.com ইউআরএলের ওয়েবসাইটিতে ব্যালেন্স, রিচার্জ, উইথড্রো অপশন ছাড়াও বিভিন্ন পণ্যের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রয়েছে। যেগুলো বিক্রি করতে হয়। তিনি বলেন, প্রতারক চক্রটি শুরুতে কিছু কিছু পণ্য কেনার পর কমিশন দিত এবং সেগুলো উঠিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিত। কিন্তু বড় অঙ্কের লেনদেন করতে গেলেই সেটার কমিশন ওঠাতে গেলে আটকে দিত এবং নতুন করে আরও রিচার্জ করতে বলত। নতুন করে রিচার্জ না করলে আর উইথড্রো করতে দিত না। ধাপে ধাপে গ্রাহকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করার পর গ্রাহক বড় অঙ্কের টাকা দিলে নতুন নতুন শর্ত জুড়ে দিত তারা। নতুন শর্ত পূরণ না করলে গ্রাহকের ইতোমধ্যে দেওয়া টাকা বা তার অর্জিত মুনাফা উত্তোলনে আর কোনো পথ থাকে না। নতুন করে আর কোনো ট্রানজেকশন না করলে গ্রাহককে সব ডিজিটাল মাধ্যম থেকে ব্লক করে দিত।
এই কর্মকর্তা বলেন, এই চক্রের মূলহোতা ডেং শোয়াইমিং চীনে বসে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে প্রতারণার জাল ফেলেছেন। এরপর তার দুই কর্মী ঝ্যাং পিং, ঝ্যাং ইরউয়াকে বাংলাদেশে পাঠান। তারা এখানে এসে দেশি দুই ব্যক্তিকে সহযোগী হিসেবে খুঁজে বের করেন। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন অপারেটরের অন্তত তিন হাজার সিমকার্ড জব্দ করা হয়েছে। সবই বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
ডিবি জানিয়েছে, এই চক্রের সদস্যরা লোভনীয় চাকরির বিজ্ঞাপন দিত ফেসবুক ও ইউটিউবে। অ্যামাজনে চাকরি, দিনে ১৫ থেকে ২০ মিনিট কাজ করলে ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব—এমন কথা বলত। আগ্রহীদের আবেদন করতে আহ্বান জানাত তারা। গ্রাহক আগ্রহী হয়ে সম্মতি প্রকাশ করলে তাকে amazon99s.com ইউআরএলের একটি ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়। যার মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য কেনাবেচা করা যায়। পণ্যভেদে শতকরা ১০ ভাগ থেকে শুরু করে ৬০ ভাগ পর্যন্ত কমিশন দেওয়ার প্রলোভন দেখাত তারা। মাস্ক, টি-শার্ট, ঘড়ি, প্যান্ট, ফার্নিচারসহ নানা ধরনের পণ্যের প্রদর্শনী থাকে তাদের ওয়েবসাইটে।
অন-অ্যারাইভাল ভিসায় এসে প্রতারণা: তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চক্রটির প্রধান চীনা নাগরিক ডেং শোয়াইমিং পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন। তার প্রতিনিধি হয়ে ধাপে ধাপে চীনা নাগরিকরা বাংলাদেশে আসতেন। পর্যটক হিসেবে অন অ্যারাইভাল ভিসায় তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতেন। প্রতারণার ফাঁদ পাতার পর গত সাড়ে চার মাসে তিন ধাপে ডেং শোয়াইমিংয়ের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসেছেন। প্রতি ধাপে আসা প্রতিনিধিরা এক মাস করে থাকতেন। এরপর অন্য গ্রুপ আসত। চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার দুই চীনা নাগরিক তৃতীয় ধাপে বাংলাদেশে এসেছিল।
গ্রেপ্তার চীনা প্রতারকদের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কিছু টাকা যারা বিনিয়োগ করত, তাদের দিত। বাকি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে চীনে পাচার করত। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন উপায়ে টাকা নিয়েছে। প্রতিদিন গড়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল চক্রটি। এই টাকার সিংহভাগই তারা চীনে পাচার করেছে।
তিনি বলেন, এই চক্রের আরও যারা জড়িত আছে, বাংলাদেশে তাদের যারা সহযোগিতা করেছে, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। কীভাবে তারা টাকা চীনে পাচার করেছে, তা আমরা তদন্ত করছি।
মন্তব্য করুন