শিল্পসমৃদ্ধ জেলা হিসেবে নরসিংদীর সুনাম আছে। এই জেলার কলা, লটকনের খ্যাতি তো দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। বেলাব উপজেলার ওয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের পর জানা গেছে, বঙ্গীয় ভূখণ্ডে নগরসভ্যতার সূচনা হয় এই নরসিংদীতেই। অথচ ইতিহাস-ঐতিহ্যের এই নরসিংদীকে গত ১৬ বছর অন্ধকার যুগে নিয়ে গিয়েছিলেন পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুজ্জামান কামরুল। জনপ্রতিনিধি হয়েও পুরো জেলায় সব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
কামরুজ্জামান মেয়র থাকাকালে শত শত মানুষকে নির্মম নির্যাতন, গুম-খুন, ধর্ষণ, মামলা-হামলা, জমি দখল, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, টেন্ডারবাজিসহ এমন কোনো ঘৃণ্য কাজ নেই, যা হয়নি। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও তার অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি। ১৯৯৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন, জমি দখল, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগসহ নানা অভিযোগে বিভিন্ন থানায় সাতটি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত হত্যাসহ নতুন ছয়টি মামলা হয়েছে।
যেভাবে উত্থান: ২০০৪ এবং ২০১১ সালে পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন কামরুলের বড় ভাই লোকমান হোসেন। ভাই মেয়র থাকার সময় নরসিংদী শহরে কামরুল গড়ে তোলেন অপরাধ সাম্রাজ্য। ২০১১ সালের ১ নভেম্বর তার ভাই লোকমান হোসেন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। এরপর ২০১২ সালের ১৮ জানুয়ারি উপনির্বাচনে লোকমান হোসেনের জনপ্রিয়তাকে হাতিয়ার করে মেয়র নির্বাচিত হন কামরুল। ২০১৫ সালে দলের মনোনয়নে পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের দিকে স্থানীয় এমপির সঙ্গে মতবিরোধ ও কামরুজ্জামানের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে তাকে আর মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ থাকায় দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। কিন্তু বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। দলের বিরুদ্ধে গিয়ে জাতীয় নির্বাচন করলেও তার ক্ষমতা বা দাপট একটুকুও কমেনি।
এর আগে থেকেই তিনি পৌরসভার মেয়র থাকাকালে নরসিংদী সদরের এমপিও ছিলেন তার হাতের পুতুল। জেলার উন্নয়ন কাজের টেন্ডার থেকে শুরু করে সরকারি নিয়োগসহ সবকিছুই হতো তার নির্দেশে। তাকে ম্যানেজ করা ছাড়া পৌরসভার কাউন্সিলর, সদর উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচিত হওয়ার উপায় ছিল না কারও।
টেন্ডারবাজি: কামরুজ্জামান মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর পৌরসভার সব টেন্ডার তিনি নিজেই দখল করে নেন। তিনি নিজেই মেয়র, নিজেই ঠিকাদার, নিজেই তদারককারী, নিজের কাজের বিল নিজেই পরিশোধ করতেন। খেয়াল-খুশি মতো কাজ করে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রতিটি টেন্ডারে সব কাজ তিনি নিজে ভাগবাটোয়ারা করে তার পছন্দের চার-পাঁচজন ঠিকাদারকে দিতেন।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মাসোহারা: জেলা রেজিস্ট্রার অফিস, সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস থেকে প্রতি মাসে ৩০ লাখ টাকা, শহরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে মাসে গড়ে ৩ লাখ টাকা, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে প্রতিটি অধিগ্রহণ ভূমি থেকে ১০ শতাংশ কমিশন, পাসপোর্ট অফিস থেকে মাসে ৩ লাখ টাকা, পৌর শহরের প্রতিটি প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতাল থেকে মাসে গড়ে ১০ লাখ টাকা নিয়মিত মাসোহারা নিতেন কামরুল। এ ছাড়া পৌর শহরের বিভিন্ন সিএনজিচালিত অটোরিকশার স্ট্যান্ড, বাস টার্মিনাল, বালুমহাল, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন।
মাদক ব্যবসা: বিভিন্ন অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২১ মে ভোরে পলাশ উপজেলার ঘোড়াশালে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমান আলী। কামরুজ্জামানের ছত্রছায়ায় থেকে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করতেন ইমন। ইমান আলী মারা যাওয়ার পর তার মাদক ব্যবসা পরিচালনা এবং সব টাকা কামরুজ্জামানের কাছেই রয়েছে বলে জানা যায়।
২০১৯ সালের ২৬ মার্চ রাতে রাজধানীর ভাসানটেকের মাটিকাটা এলাকায় র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী শফিকুল ইসলাম শফিক। কামরুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং মাদক ব্যবসার অংশীদার ছিলেন রফিক। তার মাধ্যমেই নরসিংদীতে চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন কামরুজ্জামান। শফিক নিহত হওয়ার পর তার সব অবৈধ অস্ত্র এবং মাদক ব্যবসা কামরুজ্জামানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
২০১৭ সালের ৬ মে গভীর রাতে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী রাহাত সরকার গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তিনিও কামরুজ্জামানের ছত্রছায়ায় থেকে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করতেন।
কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে যত মামলা: তার বিরুদ্ধে নরসিংদী সদর থানাসহ বিভিন্ন থানায় খুন, ডাকাতি, আগুন দিয়ে পোড়ানো ও ভাঙচুর, বিস্ফোরক, মারামারি, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ সাতটি মামলা হয়েছে। মামলাগুলো হলো ২০০১ সালে সদর থানায় হত্যার অভিযোগে মামলা, ২০০১ সালে পলাশ থানায় হত্যার হুমকির অভিযোগে মামলা, ২০১১ সালে সদর থানায় অপহরণ ও চাঁদাবাজির মামলা, ২০১২ সালে সদর থানায় ডাকাতির অভিযোগে মামলা, ১৯৯৯ সালে সদর থানায় আগুন দিয়ে পোড়ানো ও ভাঙচুরের মামলা, ১৯৯৯ সালে সদর থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা এবং ১৯৯৯ সালে সদর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা।
ধর্ষণ: ১৯৯২ সালে কুলসুম নামে এক নারীকে ধর্ষণ ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় কামরুজ্জামানের নামে মামলা হলেও পরবর্তী সময়ে প্রভাব খটিয়ে মামলার কাগজপত্র গোপন করেছেন বলে শহরে প্রচার রয়েছে। ওই সময় নরসিংদী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদে শহরে বিক্ষোভ মিছিলও করেছেন।
নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড়: দেশ-বিদেশে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন কামরুজ্জামান। শহরের বাসাইল, বিলাসদী, ভেলানগর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ৮০০ শতাংশ জমি, শহরের বাসাইল এলাকায় চারতলা বাড়ি, একই এলাকায় ছয়তলার বাণিজ্যিক ভবন, নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট, বসুন্ধরাসহ ঢাকায় তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার নামে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, লন্ডন, স্পেনে রয়েছে তার হোটেল ব্যবসা ও বাড়ি। এসব দেশে পাচার করেছেন শত শত কোটি টাকা। দেশে কামরুজ্জামানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মেসার্স শামীম কনস্ট্রাকশন, ইটভাটা, সেভেন স্টার ডেভেলপার্স প্রপার্টিজ লিমিটেড, ইজি বিল্ডার্স ও ইনফিনিটি স্কাই গার্ডেন রেস্টুরেন্ট।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে বেশ কয়েকবার নরসিংদী শহরের বাসাইল এলাকায় কামরুজ্জামানের বাড়িতে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ ছাড়া তার স্ত্রী-সন্তানরা সরকার পতনের আগেই লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন।
নরসিংদী জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মাওলানা আমজাদ হোসেন বলেন, ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর রাতে ছাত্রলীগ নেতা এসএম কাইয়ুম ও কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে জেলা জামায়াতের কার্যালয়টি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কামরুজ্জামান মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর বহু অত্যাচার, নির্যাতন চলত। কোনো ব্যাপারে তার কাছে গিয়ে আমরা কোনো বিচার পেতাম না। তার ভয়ে আমরা শহরে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারতাম না।