মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৩, ০১:২১ এএম
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৩, ১০:০৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
৮ আগস্ট টিকা বিষয়ক জাতীয় কমিটির বৈঠক

ডেঙ্গুর টিকা নিয়ে এখনই ভাবছে না সরকার

রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু আক্রান্ত এক শিশু। ছবি: কালবেলা
রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু আক্রান্ত এক শিশু। ছবি: কালবেলা

এডিস মশার বিস্তার, উৎপাত ও ডেঙ্গু শনাক্ত বাড়ছে প্রতিদিন। দেশের হাসপাতালগুলোতে এখন ডেঙ্গু রোগীর উপচে পড়া ভিড়। মৃতের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। গত ২৩ বছরের মৃত্যুর রেকর্ড ভেঙেছে গত বুধবার। ডেঙ্গুর ভয়াবহতার পর ভ্যাকসিন নিয়ে কথা উঠেছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আছে দুটি টিকা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) তথ্য অনুসারে, ফ্রান্সের ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া ২০টি দেশে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেয়েছে। আর জাপানের কিউডেঙ্গা ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউকে, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, আইসল্যান্ড, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশকিছু দেশ প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ করছে। তবে এখনো টিকা প্রয়োগের বিষয়ে ভাবছে না সরকার। কারণ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত দুটি টিকার মধ্যে একটিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন দেয়নি। সব বয়সের মানুষের জন্য কার্যকর টিকাও পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া ডেঙ্গভ্যাক্সিয়ার প্রয়োগে জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও শিশু মৃত্যুর খবর রয়েছে। আরও কয়েক মাস পর্যবেক্ষণ শেষে কার্যকর টিকা পাওয়া গেলে দেশের মানুষের মধ্যে টিকা প্রয়োগের চিন্তা-ভাবনা করা হবে বলে জানা গেছে। টিকার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ৮ আগস্ট টিকা বিষয়ক জাতীয় কমিটির (ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপ) নাইট্যাগের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। নাইট্যাগের চেয়ারম্যান প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে গত ৩০ জুলাই ডেঙ্গুবিষয়ক ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধী টিকাদান কার্যক্রমের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। অধিদপ্তরের এমন তথ্যে জনমনে আগ্রহ ও কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। তবে সরকার ডেঙ্গুর টিকা বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানা গেছে।

এদিকে দেশে কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি)। ট্রায়ালের ফল সন্তোষজনক মনে করে বিজ্ঞানীদের আশাবাদ, তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল সফল হলে তিন বছর পর বাজারে দেখা যেতে পারে ডেঙ্গুর টিকা। আইসিডিডিআর,বির সংক্রামক রোগ বিভাগের বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম গণমাধ্যমকে জানান, আমরা এই টিকার দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ করেছি। ফলাফল প্রকাশের প্রক্রিয়া চলছে। এটি ৬ মাসের ব্যবধানে দুটি ডোজে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে ব্রাজিলে শেষ হয়েছে এই টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ভালো। আমরা দেশে এই টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরুর চেষ্টা করছি। এই টিকা বাজারে আসতে কয়েক বছর সময় লাগবে।

জানা যায়, ২০২২ সালে জাপানের টাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল ডেঙ্গুর টিকা কিউডেঙ্গা আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়। এটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কিউডেঙ্গা ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রতিরোধ করে ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ। হাসপাতালে ভর্তি প্রতিরোধ করে ৯০ দশমিক ৪ শতাংশ। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউকে, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, আইসল্যান্ড, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়াসহ আরও কিছু দেশ কিউডেঙ্গা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। ৪ বছর বয়স থেকে এই টিকা দেওয়া যায়। ৩ মাসের ব্যবধানে দুটি ডোজ দিতে হয়। ইন্দোনেশিয়ায় ২ ডোজ টিকার দাম ৮০ ইউএস ডলার। কিউডেঙ্গা জীবনব্যাপী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। এ ছাড়া ইউএসএর সানোফি-পাস্তুর ইনকরপোরেশন ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া নামের একটি টিকা এনেছে। একবার ডেঙ্গু হওয়ার পরই শুধু এই টিকা নেওয়া যায়। প্রতি ডোজের দাম ১১৩ দশমিক ৭৫ ডলার। সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশে এই টিকা অনুমোদিত। ভারতের প্যানেসিয়া ফার্মাসিউটিক্যাল ও সেরাম ইনস্টিটিউট যৌথভাবে একটি টিকা নিয়ে কাজ করছে। এটি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের শেষ ধাপে রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোনো টিকাকে অনুমোদন দেয়নি। এশিয়ার ডেঙ্গুপ্রবণ দেশ ইন্দোনেশিয়ায় কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনের ব্যবহার শুরু হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ভারতে টিকা উৎপাদনকরী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট প্যানাসিয়া বায়োটেক বাংলাদেশে ডেঙ্গু টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য আবেদন করেছে। বাংলাদেশও ওই টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা যায় কি না, তা ভেবে দেখছে। বিষয়টি নিয়ে ৮ আগস্ট জাতীয় টিকা সংক্রান্ত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (নাইট্যাগ) বৈঠক হতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গুর যে পরিস্থিতি, তা টিকা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) এবং ডব্লিউএইচও বলেছে, বর্তমানে ফ্রান্সের বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সানোফির তৈরি ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া; আর জাপানের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান তাকেদার বানানো কিউডেঙ্গা রয়েছে। এসব টিকা প্রয়োগ করতে ও সুফল পেতে প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় লেগে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে বিভিন্ন কমিউনিটিতে টিকা প্রয়োগ করে অভিজ্ঞতা নিতে পারি। এর বাইরে আপাতত টিকা দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কিংবা সুফল পাওয়া যাবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত কিউডেঙ্গা ও ডেঙ্গভ্যাক্সিয়ার এখনো অনুমোদন দেয়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ডেঙ্গভ্যাক্সিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুর তথ্যও রয়েছে। আমরা এখনো টিকা বিষয়ে ভাবছি না। মশক নিধন ও চিকিৎসায় জোর দিচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনার ভ্যাকসিন এক বছরের মধ্যে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে ডেঙ্গুর দুই যুগ হওয়ার পরও কেন ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে না। এই প্রশ্ন আমাকে অনেকেই করেন। এ বিষয়ে একটা কথা বলি, পৃথিবীতে ভ্যাকসিন যারা তৈরি করেন, ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। করোনা বিশ্বব্যাপী হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা আক্রান্ত হয়েছে। তাই অল্প সময়ে করোনার ভ্যাকসিন পাওয়া গেছে। কিন্তু সেইসব দেশে ডেঙ্গু নেই। ওদের মাথাব্যথা নেই। ওরা ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। ডেঙ্গুর চারটা ধরন ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। এমন কোনো ভালো ভ্যাকসিন নেই যে, চারটা ধরনেই কার্যকর। এরপরও দুটি ভ্যাকসিন নিয়ে কিন্তু কাজ হচ্ছে। ফ্রান্স তৈরি করছে ডেঙ্গভেক্সিয়া ও জাপানের কিউডেঙ্গা। ফ্রান্সের যেটা সেটা শুধু ৯ থেকে ১৬ বছরের জনগোষ্ঠীকে দেওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, আরেকটা বিষয় হলো—এই ভ্যাকসিন টেস্ট করে দেওয়া হচ্ছে। যাদের আগে ডেঙ্গু হয়েছে শুধু তাদেরই দেওয়া হচ্ছে। তাহলে সবাই তো ভ্যাকসিন পাচ্ছে না। তাহলে তো লাভ হচ্ছে না। সাইড ইফেক্ট অনেক বেশি। কয়েকজন শিশু মারাও গেছে। এখন কিউডেঙ্গার কথা বলি, ওরা বলে এটার তেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমন নেই। এটা ৬ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যের লোকজনকে দেওয়া যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই দুটি ভ্যাকসিনই কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দেয়নি। এই ভ্যাকসিন আমি না আনার জন্য বলব। ডেঙ্গুর সব ধরনের জন্য কার্যকর ভ্যাকসিনের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে অবশ্যই আনতে হবে। তার আগে মশা মারায় জোর দিতে হবে। আমরা আর কয়টা দিন অপেক্ষা করি। দেখি কোথাও কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। আমরা যদি বলি একটা কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়া গেছে। ডব্লিউএইচও রিকমান্ড করেছে। তাহলে তিনি অপেক্ষা করবেন না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘ত্রাণ নয়, রাস্তা চাই’

‘ডাকসুকে ব্যবহার করে বড় নেতা হয়েছেন, শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন হয়নি’

প্রতিজ্ঞা ভেঙে হোয়াইট হাউসে স্যুট পরে হাজির জেলেনস্কি

এনসিপি থেকে বহিষ্কার হয়ে মাহিনের ‘বিস্ফোরক’ মন্তব্য

বেরোবিতে তৃতীয় দিনেও অনশন চলছে, গঠনতন্ত্র চূড়ান্তে ইউজিসির সভা বৃহস্পতিবার

মাটির নিচে মিলল পিস্তল-গুলি

জুলাই গণহত্যার আসামির জামিন বিষয়ে আইন উপদেষ্টার বক্তব্য

নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করলে কি ৪০ দিনের ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়?

হঠাৎ অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন মার্কিন বিমানবাহিনীর প্রধান

ইসিকে ৪০ লাখ ইউরো সহায়তা দেবে ইইউ

১০

ভারতীয়রা কেন অন্ধভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করে?

১১

আ.লীগ কার্যালয়ে এবার বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের সাইনবোর্ড

১২

চমক রেখে ভারতের এশিয়া কাপ স্কোয়াড ঘোষণা

১৩

স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ

১৪

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে নতুন সচিব

১৫

ভারতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী : দুই দেশের সম্পর্ক কি স্বাভাবিক হবে?

১৬

প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুকের সাক্ষাৎ

১৭

সাতক্ষীরা সীমান্তে বিজিবির বিশেষ অভিযানে ভারতীয় মালামাল জব্দ

১৮

ডাকসু নির্বাচন / বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্যানেল ঘোষণা

১৯

‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ বার্তা ফাঁসকারী পুলিশ সদস্য রিমান্ডে

২০
X