রাজধানীর মিরপুরের বশির উদ্দিন আদর্শ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. বিল্লাল হোসেন একজন পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তা হয়ে মাসে বেতন-ভাতা হিসেবে পান প্রায় ২ লাখ টাকা। শুধু তা-ই নয়, সরকারি বেতন-ভাতা ও পিএফের বাইরে তিনি প্রতিষ্ঠান থেকে নিজের ইচ্ছামতো বাড়ি ভাড়া, সেমিস্টার ভাতা ও সিটি ভাতা নেন। নিজ স্বার্থে প্রতিষ্ঠানটির স্কুল ও কলেজ শাখাকে আলাদা করে কলেজ শাখার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিচ্ছেন না তিনি। তারা বকেয়া পাঁচ মাসের বেতন চাইলে উল্টো হুমকি দিচ্ছেন। সাবেক সরকারের সময়ে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া এ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলে প্রতিকার চাইলেও তাতে কর্ণপাত করছেন না গভর্নিং বডির সভাপতি। অথচ এই বডির বেশিরভাগ সদস্যই অধ্যক্ষের অনিয়মের বিপক্ষে। তাদের অভিযোগ, সভাপতি উপসচিব জিয়াউর রহমান অধ্যক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হক, সাবেক সংসদ সদস্য আগা খান মিন্টু এবং ঢাকা-১৪ আসনের সর্বশেষ সংসদ সদস্য যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলের সঙ্গে বিল্লাল হোসেনের সখ্য ছিল। এ কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। এমনকি গভর্নিং বডির সভাপতিকেও তিনি মানতেন না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে তিনি সম্মুখসারির শিক্ষক ছিলেন। যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের যে কোনো প্রোগ্রামে তাকে দেখা যেত। ছাত্র আন্দোলন দমনে যুবলীগের কর্মসূচিতে তিনিও ছিলেন বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ জুলাইয়ে অধ্যক্ষ ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা বেতন-ভাতা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান থেকে ৭৫ শতাংশ বাড়িভাড়া নেন। অথচ সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী বাড়িভাড়া বেতনস্কেলের ৫০ শতাংশ। শিফটিং অ্যালাউন্স হিসেবে তিনি নেন বেতনস্কেলের ৭৫ শতাংশ। এটিও বিধিসম্মত নয়। এ ছাড়া সরকারি বেতন-ভাতা ও পিএফের বাইরেও তিনি বেতনস্কেলের ৫০ শতাংশ সেমিস্টার ভাতা এবং বেতনস্কেলের ৬০ শতাংশ সিটি ভাতা নেন।
বিধি অনুসারে গভর্নিং বডির সভাপতি ও সদস্যরা নিয়োগ পরীক্ষার সম্মানী ছাড়া আর কোনো পারিশ্রমিক নিতে পারবেন না। অথচ অধ্যক্ষ গভর্নিং বডির সবার জন্য সিটিং অ্যালাউন্স পাস করান। সভাপতির জন্য ২ হাজার টাকা ও সদস্যদের জন্য ১ হাজার টাকা। পরবর্তী সময়ে এটি বাড়িয়ে সভাপতির জন্য ৫ হাজার টাকা ও সদস্যদের জন্য ২ হাজার টাকা করা হয়।
প্রতিষ্ঠান সূত্র বলছে, বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি বছর গভর্নিং বডির অনুমোদন নিয়ে নিরীক্ষক কোম্পানি দিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হিসাব নিরীক্ষণ করার কথা। তিনি সেটি করাননি। ২০২২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অডিট চলাকালে তার দুর্নীতি ধরা পড়লে তিনি অর্থের বিনিময়ে অডিটরকে ম্যানেজ করে ফেলেন। এজন্য শিক্ষকদের জোর করে স্বাক্ষর নিয়ে আড়াই লাখ টাকা উত্তোলন করেন। যার একটি অংশ ঢুকে অধ্যক্ষের পকেটে।
অধ্যক্ষ তার ঘনিষ্ঠ নজরুল ইসলামকে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনবার নিয়োগ পরীক্ষা নেন এবং শেষ পর্যন্ত তাকেই নিয়োগ দেন। সেই নজরুল ইসলাম ছাত্রীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কারণে ইস্তফার মাধ্যমে বরখাস্ত হন। অথচ তাকেই ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় রয়েছেন অধ্যক্ষ।
নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই অধ্যক্ষ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গভর্নিং বডির সভায় তা পাস করিয়েছেন। আবার সেখানেও রয়েছে গরমিল। মফিজুল আলম নামে একজনকে গণিতের শিক্ষক হিসেবে খণ্ডকালীন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রার্থীর গণিত বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স থাকতে হবে। কিন্তু মফিজুল আলম অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন পদার্থবিজ্ঞানে।
২০১৪ সালে অধ্যক্ষ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক সহকারী পরিচালকের স্বাক্ষর জাল করে চিঠি বিলি করায় অধিদপ্তরের তদন্তে সেটি ভুয়া প্রমাণিত হয়। এরপর মাউশি থেকে ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নোটিশ পাঠানো হয়। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলেন। গভর্নিং বডির সাবেক সভাপতি আলী আকবার আকন্দের স্বাক্ষর জাল করলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে বিল্লাল হোসেন দলাদলি সৃষ্টি করেছেন। বিশেষ করে কলেজ শাখার শিক্ষকদের সঙ্গে তিনি বিমাতাসুলভ আচরণ করেন। স্কুল শাখা ২০১৫ সালের স্কেল অনুযায়ী বেতন পেলেও কলেজ শাখার শিক্ষকরা ৩৩ মাস ধরে ২০০৯ সালের জাতীয় বেতনস্কেলে বেতন পাচ্ছেন। আবার ৫ মাস ধরে কলেজ শাখার শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো বেতনও দিচ্ছেন না। এদিকে কলেজ শাখায় করেছেন দুই নীতি। কলেজ শাখার অনেকেই ২০০৯ সালের স্কেলে বেতন পেলেও অধ্যক্ষের কাছের শিক্ষক ও কর্মচারীরা ২০১৫ সালের জাতীয় বেতনস্কেলে নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন।
এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে নারী শিক্ষকদের নামে বাজে মন্তব্য ও দুর্ব্যবহার; একজন সাবেক সিনিয়র শিক্ষিকাকে অন্যায়ভাবে বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত করা; ডোনেশনের বই থেকে টাকা আত্মসাৎ করা; গভর্নিং বডির নির্বাচনে টাকা আত্মসাৎ করা; অনুগত শিক্ষক ও কর্মচারীদের ক্যান্টিন ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া; স্কুল ও কলেজ শাখার শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রুপিং করাসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
অনিয়মের বিচারসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অংশ নেওয়ায় তার পদত্যাগের দাবি ওঠে। এর মধ্যেই গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সাবেক ছাত্ররা এলাকাবাসীকে নিয়ে একটি সভা ডাকলে সেখানে অধ্যক্ষ তার ভাইয়ের নেতৃত্বে ছেলেমেয়ে, মেয়ের জামাই ও বহিরাগত কিছু সন্ত্রাসীকে দিয়ে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেন। এ ছাড়া এ ঘটনার পরও বিল্লাল হোসেনকেই সমর্থন দিয়ে গেছেন গভর্নিং বডির সভাপতি মো. জিয়াউর রহমান। অধ্যক্ষের অনিয়মের বিপক্ষে যাতে কেউ দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সাজিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানে পাঠান।
নাঈম হাসান, আব্দুল্লাহ হাসান সোহান ও মাহমুদা জান্নাত নামের ওই তিন শিক্ষার্থীই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। তারা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগী হিসেবে শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাঈম হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের জিয়া স্যার পাঠিয়েছেন, ওখানে কী কী সমস্যা আছে, তা সমাধান করার জন্য। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেউ নই। স্যার বলায় সেখানে গিয়েছি।’
আব্দুল্লাহ হাসান সোহান বলেন, ‘স্যার আমাদের সেখানে পাঠিয়েছেন। আমরা কোনো ক্ষমতা সেখানে দেখাইনি।’
প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার একাধিক শিক্ষক কালবেলাকে বলেন, অধ্যক্ষের অদক্ষতার কারণে প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। তিনি এর দায় কলেজ শাখার শিক্ষকদের ওপর দিতে চান। তারা বলেন, খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার যে নিয়ম, অধ্যক্ষ সেটি মানেননি। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তার পছন্দের প্রার্থীদের সরাসরি ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
বশির উদ্দিন আদর্শ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. বিল্লাল হোসেনের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন। শিফটিং অ্যালাউন্স, সেমিস্টার অ্যালাউন্স, সিটি ভাতাসহ বেতন প্রায় ২ লাখ টাকা কীভাবে নেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, একেক স্কুলে একেক নিয়ম। আমাদের এখানে আগ থেকেই অধ্যক্ষরা ৭৫ শতাংশ বাড়িভাড়া নিতেন। আমিও তা নিই। এ ছাড়া বাকি ভাতা গভর্নিং বডির অনুমতি নিয়েই নেওয়া হয়।
স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এটিকে মীমাংসিত ইস্যু বলে এড়িয়ে যান। খণ্ডকালীন শিক্ষকদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব নিয়োগও গভর্নিং বডির অনুমোদনে হয়েছে। এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া যায় বলে দাবি তার। এনটিআরসিএ গঠনের পরে নিবন্ধন সনদ ও সুপারিশ ছাড়া এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির অনুমোদন ছাড়া কীসের ভিত্তিতে তাদের নিয়োগ দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, গভর্নিং বডির অনুমোদন নিয়ে। কলেজ শাখার শিক্ষকদের আলাদা করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কলেজ শাখার শিক্ষার্থী কমে যাওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে, সেটি প্রমাণ করুক। এরপর যে শাস্তি দেওয়া হয়, আমি মেনে নেব।
বশির উদ্দিন আদর্শ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন অঞ্চল-২-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিয়াউর রহমান কালবেলাকে বলেন, আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন, কোনো অনিয়ম আছে কি না। এ ছাড়া আমি প্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ থেকেও পদত্যাগ করেছি। এই বলে তিনি কল কেটে দেন।