বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা আগামীকাল বুধবার থেকে শুরু হতে যাচ্ছে। এই উৎসব ঘিরে সারা দেশের মণ্ডপে মণ্ডপে এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। এরই মধ্যে প্রতিমা তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অনেক জায়গায় এখন চলছে মণ্ডপ তৈরি, আলোকসজ্জা ও সাজসজ্জার কাজ, যা আজকের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যাবে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দুর্গাপূজা ঘিরে যথেষ্ট উদ্বেগ-শঙ্কা থাকলেও সরকারসহ সব মহলের নিরাপত্তার আশ্বাসে কেটেছে সে শঙ্কা। সনাতনীরা এখন নির্বিঘ্নে পূজা সম্পন্ন হওয়ার প্রত্যাশায়। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সারা দেশে ৩১ হাজার ৪৬১টি মণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে পূজার সংখ্যা হবে ২৫৩টি।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিস্থিতিতে নির্বিঘ্নে দুর্গাপূজা উদযাপনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দেয়, তৈরি হয় নিরাপত্তার শঙ্কা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের সব মহল থেকে তাদের আশ্বস্ত করা হয়। আশ্বস্ত করা হয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সার্বিক নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে।
গত বুধবার মহালয়ার মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। শুভ মহালয়ায় দেবীর আবাহন শেষে এখন মণ্ডপে মণ্ডপে দেবী বরণের প্রস্তুতি চলছে। কৈলাশ থেকে মর্ত্যলোকে আসবেন দেবী দুর্গা। আজ মঙ্গলবার সায়ংকালে দেবীর বোধন। আগামীকাল বুধবার দুর্গা দেবীর ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ ও বিহিতপূজা হবে। পরদিন বৃহস্পতিবার দুর্গাদেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন সপ্তমাদি কল্পারম্ভ ও মহাসপ্তমী বিহিত পূজা। শুক্রবার দুর্গাদেবীর মহাঅষ্টমী কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজা। শনিবার পূর্বাহ্ন ৬.১২টার মধ্যে দুর্গাদেবীর মহানবমী কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজা। একই দিন পূর্বাহ্ন ৮.২৬টার মধ্যে দুর্গাদেবীর দশমী বিহিতপূজা ও পূজান্তে দর্পণ বিসর্জন। ১৩ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী এ উৎসবের শেষ হবে। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, এ বছর দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসছেন দোলায় চেপে, ফিরবেন ঘোটকে (ঘোড়া) চড়ে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বলেন, পূজার প্রস্তুতি এখন প্রায় সম্পন্ন। সারা দেশেই কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে পূজার। এরই মধ্যে আমরা সারা দেশে নির্দেশনা দিয়েছি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে পূজা করার জন্য, সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে পূজার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে। এরই মধ্যে সরকারের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। সেখানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ আইজিপি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, পূজাকে ঘিরে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। এমনকি প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। প্রতিটি পূজামণ্ডপে নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সবার মধ্যে আস্থার মনোভাব রয়েছে। আশা করছি, শারদীয় দুর্গোৎসবে কোনো সমস্যা হবে না।’
এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শারদীয় দুর্গাপূজাকে উৎসবমুখর করতে এবং দুর্গাপূজা ঘিরে কেউ যাতে কোনো ধরনের নাশকতা-সহিংসতা করতে না পারে, সেজন্য দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সমন্বয়ক করে বিভাগীয় সমন্বয়ক টিম গঠন করেছে বিএনপি। তারা এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে উৎসবমুখর করতে মণ্ডপে মণ্ডপে বিএনপি নেতাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে যেন সনাতনীরা দুর্গাপূজা করতে পারে, সেজন্য বিএনপি মণ্ডপে মণ্ডপে স্বেচ্ছাসেবক টিম করেছে। ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও জেলায় সমন্বয় টিমের পাশাপাশি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। তাই আমি মনে করি, কোনো সমস্যা ছাড়াই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পূজা উদযাপন করতে পারবে। বিএনপি আগেও সনাতনীদের পাশে ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আপনারা নির্ভয়ে জাঁকজমকভাবে দুর্গাপূজা উদযাপন করুন।
দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর হেলাল বলেন, দুর্গাপূজা দেশের মানুষের কাছে সম্প্রীতির নজির হয়ে থাকবে। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা যতই ষড়যন্ত্র করুক, তা দেশের জনগণ রুখে দেবে। বিএনপি নেতাকর্মীরা দিনরাত আপনাদের পাশে থাকবে।
জামায়াতের পক্ষ থেকেও দুর্গাপূজায় প্রয়োজনে মণ্ডপ পাহারা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নির্বিঘ্নে ও উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে দলটি। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও একই কথা বলেছে।
ভীতিমুক্ত পরিবেশে পূজা উদযাপনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও সার্বিক নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সেনাপ্রধান ও পুলিশপ্রধান ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদর্শন করেছেন। গত শনিবার মন্দির পরিদর্শন শেষে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, দুর্গাপূজা সামনে রেখে সারা দেশে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। তাই সবাই নির্ভয়ে পূজামণ্ডপে যান। গতকাল সোমবার ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন শেষে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল ইসলাম বলেন, দুর্গাপূজায় কোনো ধরনের অপতৎপরতার সুযোগ নেই। মোবাইল টিমসহ স্ট্রাইকিং ফোর্স মণ্ডপের কাছাকাছি দূরত্বে থাকছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি পূজামণ্ডপে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আনসার বাহিনী ও ভলান্টিয়ার গ্রুপ রয়েছে। তারা ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে, কোথাও কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা অপতৎপরতার কোনো সুযোগ নেই। উদ্বেগ থাকলেও আনন্দমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা উৎসব উদযাপনের আশা প্রকাশ করে পুলিশপ্রধান জানান, পূজায় সব মিলিয়ে মোতায়েন হবে ২ লাখ ১২ হাজার ১৯২ জন আনসার-ভিডিপি সদস্য। এর মধ্যে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত ১৫ হাজার ৩২টি মণ্ডপে থাকবেন ৫৩ হাজার ১৪৮ জন।
সরকার ও প্রশাসনের আশ্বাসে ঢাকার বাইরেও উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা আয়োজনের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। বগুড়া জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার ১২টি উপজেলায় ৬২৮টি মণ্ডপে এবার দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু কুমার রায় নির্মল কালবেলাকে বলেন, পূজা উদযাপনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন পূজামণ্ডপগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। পূজামণ্ডপগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনীও কাজ করছে। তিনি বলেন, মণ্ডপগুলোতে সিসিটিভি লাগানোর জন্য বলা হয়েছে। নিরাপত্তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন নন।