পদ্মা ব্যাংক পিএলসিতে (সাবেক দি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড) বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) গচ্ছিত স্থায়ী আমানতের হিসাবে ধরা পড়েছে গরমিল। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সুদসহ দেওয়া অর্থের হিসাবের সঙ্গে বিটিআরসির হিসাবে প্রায় আড়াই কোটি টাকার পার্থক্য ধরা পড়েছে। গরমিলের সেই টাকা কার পকেটে ঢুকেছে সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিটিআরসি ও ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এ ছাড়া একই সময়ে একই ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় সুদের হার ভিন্ন, এমনকি একই শাখায় দুটি আমানতের হার ভিন্ন হওয়ায় বিটিআরসি ও ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলেও কানাঘুষা চলছে। টাকা ফেরত না দেওয়ার পেছনে ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফত কলকাঠি নেড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ভঙ্গুর এই ব্যাংক থেকে বিটিআরসির স্থায়ী আমানতের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
রাজধানীতে পদ্মা ব্যাংকের ৫টি শাখায় রাখা স্থায়ী আমানতের মেয়াদ সাত বছর আগে পূর্ণ হয়ে গেলেও ফেরত দেওয়া হচ্ছে না অর্থ। এমনকি সুদাসলে কত টাকা ব্যাংকের কাছে বিটিআরসির পাওনা রয়েছে সেই হিসাবও দিতে করে গড়িমসি। অবশেষে ছয় বছর পর গত বছরের মার্চে ব্যাংক থেকে দেওয়া হয় সুদাসলের হিসাব আর তাতেই ধরা পড়ে আড়াই কোটি টাকার গরমিলের তথ্য।
জানা গেছে, পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে অন্তত অর্ধডজন সভা, বেসরকারি ব্যাংক ও এর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ৫৫টি চিঠি দিয়েও মেলেনি সমাধান। এমনকি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রাণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে ৬টি ডিও লেটার (আধা সরকারি পত্র) দিয়েও ফেরত দেওয়া হয়নি স্থায়ী আমানতের অর্থ।
এবিষয়ে পদ্মা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মো. তালহা কালবেলাকে বলেন, যদিও আমানত সংক্রিয়ভাবে নবায়ন হয়ে যায়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বেতন দিতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে আমানতের এত বড় অঙ্কের টাকা ফেরত দেব কীভাবে? ব্যাংকে কোনো টাকাই নেই। কোনো গরমিল হওয়ার কথা না, সুদের হারে নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে।
বিটিআরসি কমিশনের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, পদ্মা ব্যাংকের গুলশান করপোরেট শাখা, মতিঝিল, মিরপুর, বসুন্ধরা এবং ইমামগঞ্জ এই ৫টি শাখায় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৮ কোটি টাকার ১২টি স্থায়ী আমানত রাখা হয়। এর মধ্যে গুলশান, মতিঝিল ও মিরপুর শাখায় ৫ দশমিক ৪ কোটি করে, বসুন্ধরা ও ইমামগঞ্জ শাখায় ১১ দশমিক ৪ কোটি টাকা গচ্ছিত রাখা হয়। একই বছর ৩১ ডিসেম্বর স্থায়ী আমানতের মেয়াদ পূর্ণ হলেও পদ্মা ব্যাংক টাকা না দেওয়ায় একাধিকবার সভা, ডজন ডজন চিঠি ও ডিও লেটার দেয় টেলিকমের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি।
ফলশ্রুতিতে ২০১৯ সালের জুন থেকে জানুয়ারি ২০২৩ সালে সাত দফায় ১২ দশমিক ৬ টাকা আমানতের সুদাসলে ১৬ দশমিক ১ কোটি টাকা ফেরত দেয় বিটিআরসিকে। এর মধ্যে গুলশান শাখা ২০১৯ সালের জুনে পুরো টাকা ফেরত দেয়। মিরপুর শাখা ২০২০ সালের মার্চ ও বসুন্ধরা শাখা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২ দশমিক ৪ কোটি টাকার সুদাসলে ফেরত দেয়। অন্যদিকে ইমামগঞ্জ শাখা তিন দফায় ২ দশমিক ৪ কোটি টাকার সুদসহ ফেরত দেয়। এর মধ্যে ২০২২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে এক কোটি করে ও ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৪০ লাখ টাকা সুদাসলে ফেরত দেয় বিটিআরসিকে। এরপর পদ্মা ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় ২৫ দশমিক ৪০ কোটির সাতটি আমানত রয়ে যায়।
এরপর বিভিন্ন সময়ে হিসাব চাওয়া হলেও ব্যাংকটি টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করে। চলতি বছরের আগস্টে কমিশন সভায় বিষয়টি উত্থাপিত হলে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠানো হলে অবশেষে ব্যাংক আমানতের মার্চ ২০২৩ সাল পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য দেয়। এতে ধরা পড়ে ব্যাংকের হিসাবে গরমিল।
কার্যপত্রে দেওয়া হিসাবে দেখা গেছে, বিটিআরসি ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকের কাছে পায় ৩৯ কোটি ৪২ লাখ এর কিছু বেশি টাকা। অন্যদিকে ব্যাংকের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী বিটিআরসির পাওনা ৩৬ কোটি ৯৫ লাখের কিছু বেশি টাকা। এতে প্রায় ২ দশমিক ৪৭ কোটি টাকার গরমিল ধরা পড়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী এখনো পদ্মা ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় ৫ দশমিক ৪ কোটি, মিরপুরে ৭ কোটি, বসুন্ধরায় ৯ কোটি, ইমামগঞ্জে ৮ কোটি টাকার দুটি করে স্থায়ী আমানত রয়েছে।
এদিকে বিটিআরসি সূত্র জানায়, তৎকালীন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে একই ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সুদে টাকা আমানত রাখা হয় কেন তা সন্দেহজনক। একই শাখায় আমানতের হার কেন ভিন্ন তা নিয়েও কানাঘুষা রয়েছে। কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়, মতিঝিলে ৮ শতাংশ হারে, মিরপুরে সাড়ে ৮ শতাংশ হারে, বসুন্ধরায় চার কোটি টাকা ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও ৫ কোটি টাকা ৮ দশমিক ৫০ হারে, ইমামগঞ্জে ৫ কোটি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৩ কোটি টাকা ৮ শতাংশ হারে গচ্ছিত রাখা হয়।
জানা গেছে, পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন চৌধুরী নাফিজ সরাফত। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক থাকায় বিটিআরসির অর্থ আদায়েও কর্মকর্তারা ভয়ে থাকতেন। ফলে ডজন ডজন চিঠি, বৈঠক, ডিও লেটার দিয়েও আদায় করা যায়নি গচ্ছিত অর্থ। সূত্র মতে, বিটিআরসির কমিশনার (অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগ) মুশফিক মান্নান চৌধুরীর আমলে এই টাকা উদ্ধারেও নেয়া হয়নি তেমন দৃশ্যমান উদ্যোগ।
বিটিআরসির অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগের পরিচালক আফতাব মো. রাশেদুল ওয়াদুদ ঘটনা স্বীকার করলেও আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ বিষয়ে জানতে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল এমদাদ উল বারীর সঙ্গে বেশ কয়েকদিন কয়েকবার কল করে ও ম্যাসেজ পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
জনসংযোগ কর্মকর্তা উপপরিচালক জাকির হোসেন খানের কাছে প্রশ্ন পাঠিয়েও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সদুত্তর পাওয়া যায়নি।