শতভাগ রাজস্ব আদায় ও সিস্টেম লস কমাতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) দেশের বিভিন্ন জেলায় স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে ঝামেলামুক্ত ও দ্রুত সেবা নিশ্চিত করা। তবে প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ও ঋণের সুদ বাড়ার কারণে বিপিডিবি গ্রাহক সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ফলে ২ লাখ ২৮ হাজারের বেশি গ্রাহক স্মার্ট মিটারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চার বিভাগের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের জন্য এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর উচ্চ সুদের ঋণ নিয়ে বিপিডিবি সিঙ্গেল-ফেজ ও থ্রি-ফেজ স্মার্ট মিটার স্থাপনের কাজ শুরু করে। প্রকল্পের শুরুতে ৪ শতাংশ সুদ নির্ধারিত থাকলেও বাস্তবায়নের মাঝপথে এসে সুদের হার বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ২০ বছর থেকে কমিয়ে ১৫ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০২২ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ মুহূর্তে এসে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি এবং ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ব্যয় বেড়েছে। ৮৫ টাকা ধরে ডলার রেট হিসাব করা হলেও বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকায়। ফলে প্রকল্প সংশোধন করে ব্যয় বৃদ্ধি ও গ্রাহক সংখ্যা হ্রাসের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
২০২২ সালে অনুমোদিত ‘স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ইন ডিস্ট্রিবিউশন জোনস অব বিপিডিবি’ প্রকল্পের প্রাথমিক বাজেট ছিল ৬১৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে এডিবির ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২৯ কোটি টাকা। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১০ লাখ ২০ হাজার সিঙ্গেল-ফেজ এবং ৩০ হাজার থ্রি-ফেজ স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল।
কিন্তু প্রকল্প সংশোধনীতে বাজেট বাড়িয়ে ৭৭২ কোটি ৩ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি মিটার স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়ে আনা হয়েছে—
সিঙ্গেল-ফেজ মিটার: ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৫৮১টি (মূল পরিকল্পনার তুলনায় ২ লাখ ২২ হাজার ৪১৯টি কম)। থ্রি-ফেজ মিটার: ২৩ হাজার ৯৬৩টি (৬ হাজার ৩৭টি কম)। ডাটা কনসেনট্রেটর ইউনিট (ডিসিইউ): ১ হাজার ৭৫২টি কম। হ্যান্ড হেল্ড ইউনিট: ৫টি কমানো হয়েছে।
অঞ্চলভিত্তিক পরিবর্তন: শুরুর পরিকল্পনায় ৪টি বিভাগের ১৬টি উপজেলা ও ৩টি সিটি করপোরেশনে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও, সংশোধনীতে উপজেলা সংখ্যা কমিয়ে ১০টি করা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগ বাদ দেওয়া হয়েছে, ফলে শুধু কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। সিলেট বিভাগের মধ্যেও শুধু সিলেট সিটি করপোরেশনে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাকি প্রকল্পের বেশিরভাগ অংশ চট্টগ্রাম বিভাগেই বাস্তবায়িত হবে।
সংশোধনের কারণ: বিপিডিবির দাবি, এডিবির ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, লোন পিরিয়ডের পরিবর্তন এবং ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন হয়েছে। মূল ডিপিপি অনুযায়ী এডিবির ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ এবং লোন পিরিয়ড ২০ বছর নির্ধারিত থাকলেও, ২০২৩ সালের ৮ জুন স্বাক্ষরিত সাবসিডিয়ারি লোন এগ্রিমেন্ট (এসএলএ) অনুযায়ী সুদের হার ৬ শতাংশ করা হয় এবং লোন পিরিয়ড কমিয়ে ১৫ বছর নির্ধারণ করা হয়। ফলে ব্যয় সংকোচন নীতির অংশ হিসেবে বিপিডিবি গ্রাহক সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. মোজাহারুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে মূলত ডলারের দাম বাড়ার কারণে। আমরা যখন টেন্ডার করেছি তখন ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, এখন তা ১২০ টাকা। এডিবির সুদের হার বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, এডিবির সুদের হার ৪ শতাংশ ছিল, তা এখন ৬ শতাংশ হয়েছে। মিটারের সংখ্যা কমার কারণ হিসেবে মোজাহারুল ইসলাম বলেন, সরকারের ব্যয় সাশ্রয় পরিকল্পনার কারণেই মিটারের সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি পরে আবার বাস্তবায়ন করা হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পটি নিয়ে গত ২৩ জানুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অগ্রগতিও প্রায় শেষের দিকে। কাজ শুরু হওয়ার প্রায় ২ বছর ৯ মাসে প্রকল্পের আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি প্রায় ৭০ শতাংশ।
বৈঠক সূত্র জানায়, সভায় প্রকল্পটির বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি প্রকল্পের কর্মপরিধিতে পরিবর্তনের ফলে প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে কি না এবং সংশোধনী প্রস্তাবে যেসব কাজ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হলেও সেটা বাদ দিতে বলা হয়েছে।