দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে খুলনার রূপসায় গড়ে তোলা হয় ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। তবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও জ্বালানির কোনো সংস্থান হয়নি। এতে কেন্দ্রটির যন্ত্রপাতি সচল রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য শুধু যন্ত্রপাতি সচল রাখতে বছরে প্রয়োজনীয় কয়েকটি দিন এই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণমাত্রায় চালাতে যে পরিমাণ গ্যাস প্রয়োজন হবে, তার জোগান দিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্যাসচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রটি এখন চালানো হলে গ্যাসভিত্তিক অন্য কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় যে ঘাটতি দেখা দেবে, তা পূরণে চালাতে হবে তেলভিত্তিক কেন্দ্র। এতে ফেব্রুয়ারিতে অতিরিক্ত ১০৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। কেন্দ্রটিতে গ্যাস সরবরাহের জন্য গ্যাসের নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ করতে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) একাধিক কর্মকর্তা জানান, জ্বালানির নিশ্চয়তা ছাড়া এবং অপরিকল্পিতভাবে কেন্দ্রটি নির্মাণ করায় এখন রূপসা সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রটি চালাতে হলে বিপুল লোকসান গুনতে হবে সরকারকে। আবার বসিয়ে রাখলে ধীরে ধীরে সব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাবে। এ অবস্থায় যতদিন গ্যাসের সংস্থান না হবে, ততদিন পর্যন্ত যন্ত্রপাতি ঠিক রাখতে মাঝে মাঝে কেন্দ্রটি চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, ‘এই মাসে কেন্দ্রটি কমিশনিং করার কথা ছিল। কিন্তু গ্যাসের অভাবে তা করা যাচ্ছে না। কেন্দ্রটি করা হয়েছে অপিরিকল্পিতভাবে এবং গ্যাসের নিশ্চয়তা ছাড়াই। এখন আমরা চেষ্টা করছি কেন্দ্রটিকে সচল রাখতে। এজন্য বছরে কয়েকবার চালানো হবে।’
তিনি বলেন, কেন্দ্রটি গ্যাস পাইপলাইনের শেষে ডেথ এন্ডে অবস্থিত। এই অবস্থায় এটি চালাতে হলে আপস্ট্রিমে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে হবে। এটা এখন সম্ভব নয়।
রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিবেদন দিতে গত ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) কে এম আলী রেজাকে প্রধান করে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সম্প্রতি কমিটি তাদের প্রতিবেদন বিদ্যুৎ বিভাগে জমা দেয়। প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ করে কমিটি। এগুলো হলো নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রদত্ত শিডিউল অনুযায়ী আপস্ট্রিম গ্যাস রেশনিংয়ের মাধ্যমে এলেঙ্গা প্রান্তে গ্যাসের চাপ ৪১০ পিএসআইর অধিক হলে, সিরাজগঞ্জ ও ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রেখে রূপসা কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কমিশনিং সম্পন্ন করা যেতে পারে। এ ছাড়া চলতি মাসে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বরাদ্দ পাওয়া গেলে রূপসা প্রকল্পের প্রথম ইউনিট কমিশনিংয়ের জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে। তবে ২২ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রয়োজনীয় ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ১৫০ পিসিআই চাপে সরবরাহ করতে হলে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের গ্যাসচালিত সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হবে এবং রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। ফলে গ্যাসচালিত ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পাবে। সামগ্রিক বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্য প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখার প্রয়োজন হবে। এর ফলে আনুমানিক ১০৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে।
সুপারিশে আরও উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকায় এবং পেট্রোবাংলা থেকে ১৫শ-১৬শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চাহিদার বিপরীতে ১২শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বরাদ্দের প্রক্ষেপণ করার কারণে আগামী গ্রীষ্ম, রমজান ও সেচকালীন চাহিদা পূরণ করে রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়মিত ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। ফলে রূপসা ৮শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট কমিশনিংয়ের পর রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এ স্থাপনা যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য আপস্ট্রিম গ্যাস রেশনিংয়ের মাধ্যমে এলেঙ্গা প্রান্তে প্রয়োজনীয় গ্যাসের চাপ নিশ্চিত করে মাসে ১-২ দিন পার্ট লোডে পরিচালনা করার জন্য ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যেতে পারে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এই কেন্দ্রটি যখন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়, তখন আপস্ট্রিমে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল না। কিন্তু বিগত সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের আপস্ট্রিমে তিনটি বড় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়, যে কারণে ডাউনস্ট্রিমে থাকা রূপসা কেন্দ্রটি এখন প্রয়োজনীয় চাপে গ্যাস পাচ্ছে না। এমনকি ২০২৭ সাল পর্যন্ত চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া যাবে না।
কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, প্রকল্প গ্রহণের সময় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রূপসায় গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অজানা কারণে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা না করে ২০১৯ সালে বেসরকারিভাবে গড়ে তোলা প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয় বিগত সরকার। এই তিন কেন্দ্র হচ্ছে মেঘনাঘাটে বেসরকারি খাতের সামিট গ্রুপের ৫৮৩ মেগাওয়াট, ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপের ৭১৮ মেগাওয়াট ও ইউনিক গ্রুপের ৫৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। বেসরকারি খাতের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে পিডিবিকে।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, খুলনায় এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প নেওয়ার আগে ২০১৩ সালে ভারতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এইচ এনার্জি পশ্চিমবঙ্গের দীঘায় তাদের এলএনজি টার্মিনাল থেকে বাংলাদেশ সরকারকে রিগ্যাসিফাইড এলএনজি সরবরাহের প্রস্তাব দেয়। মূলত এ প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে রূপসায় ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এলএনজি সরবরাহের জন্য নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (নওপাজেকো) ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এইচ এনার্জির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। তবে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে বিশেষ আইনের অধীনে এই সমঝোতা হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার তা বাতিল করে। এতে রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এইচ এনার্জির কাছ থেকে এলএনজি প্রাপ্তির বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালের ২২ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) রূপসার এ ৮০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। একনেকে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ২ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা আর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। একনেকে অনুমোদন পেয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ ২০১৮ সালের ২ আগস্ট এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করে।