আমজাদ হোসেন হৃদয়
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৫, ০৯:১২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাক্ষাৎকার : উমামা ফাতেমা

কারও একক সিদ্ধান্তে সংগঠন বিলুপ্ত হবে না

কারও একক সিদ্ধান্তে সংগঠন বিলুপ্ত হবে না

জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা, সাম্প্রতিক মব ভায়োলেন্স, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সরকারের ব্যর্থতা, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, জাতীয় নির্বাচন, ছাত্রসংসদ নির্বাচন, ছাত্রদের নতুন দল গঠনসহ নানান বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা।

কালবেলা: জুলাইয়ের চেতনা কতটা পূরণ হয়েছে, সে অনুযায়ী সরকার কি সফল?

উমামা ফাতেমা: সরকারের পক্ষ থেকে অনেক জায়গায় অনেক চেষ্টাই ছিল। যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নানা ক্ষেত্রে আওয়ামী সিন্ডিকেট রয়ে গেছে, সে কারণে সরকার ওই অর্থে অ্যাকটিভ হতে পারেনি। প্রশাসনও সরকারকে সহায়তা করেনি। ফলে প্রথম তিন-চার মাস দেশ এক প্রকার অস্থিরতার (আনরেস্ট) মধ্যেই ছিল। প্রথম দুই মাস সুযোগ ছিল পরিস্থিতি ভালো করার, কিন্তু ধানমন্ডি ৩২ ভাঙার পর যে মব ক্রিয়েট হলো, দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর হলো, সরকার কিন্তু সেটা সিরিয়াসলি দমন করতে পারত। অ্যাকশন নিলেই সেগুলো কন্ট্রোলে চলে আসত। যার ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ একেবারেই নেই। যার প্রতিফলন জনমনে এখন দেখা যাচ্ছে। আবার মানুষের মনে এক ধরনের হতাশা তৈরি (ফ্রাস্টেশন ক্রিয়েট) হচ্ছে যে, জনগণ আওয়ামী লীগের বিচার যে দ্রুতগতিতে দেখতে চেয়েছিল, তার রায় তো দূরের কথা, এখনো চার্জশিটই রেডি হয়নি। সব কিছুই জনমনে হতাশা তৈরি করেছে।

কালবেলা: আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিষয়ে আপনাদের বক্তব্য কী?

উমামা ফাতেমা: আমাদের মধ্যে সবারই চাওয়া ছিল, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে যেন নিষিদ্ধ করা হয়। গত তিনটা জাতীয় নির্বাচন তো আসলে নির্বাচন নামের কলঙ্ক। যদি এমনটা করা যায়, এই তিনটা নির্বাচন নিষিদ্ধ করা গেছে, তাহলে পরবর্তী সরকারের জন্য এটা একটা ওয়ার্নিং হিসেবে থাকবে। এই নির্বাচনগুলোকে নিষিদ্ধ করার কথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু থেকেই বলে আসছে। জাতিসংঘ থেকে রিসেন্টলি যে রিপোর্টটা এলো, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের প্রধান ভলকার টুর্ক, উনি কিন্তু বলেছেন, আওয়ামী লীগের বিচার হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার মানে, আইসিসিতে (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) যদি মামলা করা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দিকে এগোতে পারি। এটা কিন্তু একটা বড় সুযোগ এসেছে যে আন্তর্জাতিকভাবে এটি স্বীকৃতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগকে সারা পৃথিবীতে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা এটাই সরকারের পক্ষ থেকে ভালো হতে পারে। বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার রাস্তাটা তৈরি হয়েছে।

কালবেলা: নতুন দল এনসিপি নিয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই

উমামা ফাতেমা: আগে তরুণরা খুব একটা জাতীয় রাজনীতিতে আসত না। যার ফলে আমরা দেখেছি রাজনীতিতে তরুণদের একটা শূন্যতা। ৩৫-এর ওপরে কোনো নেতাই নেই। আমি চাই যে এই ধরনের তরুণ একটা দল জনবান্ধব কর্মসূচি নিক। কেন তরুণরা তাদের ভোট দেবে, সেই জায়গাটা তারা আকর্ষণ (অ্যাট্রাক্ট) করার চেষ্টা করুক। আমি মনে করি যে তরুণদের এই দল জনগণের কাছে বিশেষ গ্রহণযোগ্য হবে। আমি দলটাকে সাপোর্ট করি বিশেষ করে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণের কারণে। আমি বিশ্বাস করি, এখানে নারীরা আরও ফেস আকারে, ভোকাল আকারে উঠে আসবে।

কালবেলা: আপনার এনসিপিতে যোগ না দেওয়ার কারণ কী?

উমামা ফাতেমা: আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র হয়েছিলাম, কারণ দেশে একটা গণআন্দোলন হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান কিছু সংকট তৈরি করেছিল সোসাইটির মধ্যে। যেমন গণঅভ্যুত্থান কোশ্চেনগুলোকে রেইস করা, নারীরা যেখানে সাইট হয়ে গেল, সেটাকে সামনে নিয়ে আসা, আওয়ামী লীগের বিচারের প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসা, অভ্যুত্থানের গণআকাঙ্ক্ষার প্রশ্নগুলোকে তুলে ধরা। আমি মূলত এ কারণেই মুখপাত্র হিসেবে ছিলাম। কিন্তু এখন যেটা দেখছি, এই প্রশ্নগুলোকে যথেষ্ট অ্যাড্রেস করা হয়নি এবং এগুলোকে অ্যাড্রেস করার মাধ্যমে নিজ নিজ রাজনীতির পথ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে, যেটা আমার কাছে খুব একটা ভালো মনে হয়নি। বরং আমি মনে করি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে থেকেই আমি বেশি ভূমিকা রাখতে (ইম্প্যাক্ট ক্রিয়েট) পারব। রাজনীতি আসলে একটা ম্যারাথন রেস। রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। তবে আমার পরিকল্পনা এখনই ছাত্ররাজনীতিতে না গিয়ে আমার ফিল্ডটাটা তৈরি করা।

কালবেলা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিলুপ্তি হওয়ার আলোচনা উঠেছে, এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।

উমামা ফাতেমা: আমাদের মিটিং হয়েছিল ২ মার্চ। সেই মিটিংয়ে কিন্তু আমাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিলুপ্তির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রায় ৪০টি জেলায় আমাদের কমিটি আছে। অনেক থানায় আমাদের কমিটি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের কমিটি আছে। এই কমিটিগুলোর ব্যাপারে আসলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মটা যদি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে এই কমিটিগুলো কিন্তু বিপদে পড়বে। আমরা মনে করি, সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসব। কোনো একক সিদ্ধান্ত এই প্ল্যাটফর্ম বিলুপ্ত হবে না। সামনে আমাদের মিটিং হবে। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত আসবে। বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্ম ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন আছে এবং আমি মনে করি আমাদের অসম্পূর্ণ কাজটা শেষ করা দরকার। অন্যান্য যে স্টেকহোল্ডার এখানে আছেন, যারা ছাত্র সংগঠনে যাননি, তাদেরও এই প্ল্যাটফর্মে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া। সবাইকে নিয়ে আমি প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে চাই।

কালবেলা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সামনে কী নিয়ে কাজ করবে?

উমামা ফাতেমা: জুলাইকে নিয়ে এখন অনেক কাজ করা দরকার। ছাত্ররাজনীতির বিষয়টা এখনো সুরাহা হয়নি। জুলাই গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার হয়নি। একই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা, স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে কথা বলা—এগুলো নিয়ে আমাদের অনেক কাজ করার সুযোগ আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যদি কমিটি পুনর্গঠিত হয়, তাহলে আমরা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষ অনুযায়ী দেশ উপহার দেওয়ার জন্য কাজ করব। জুলাইয়ের আহত, শহীদদের নিয়ে অনেক কাজ বাকি আছে, সেসবে আমরা গুরুত্ব দেব।

কালবেলা: নির্বাচন নিয়ে নানান মত আছে, এ নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাই।

উমামা ফাতেমা: সরকার একবার বলছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চায়, আরেকবার বলছে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করতে চায়। এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি আগে হয়, তাহলে কীভাবে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে, এটা তো কন্ট্রাডিক্টোরি কথা হয়ে যাচ্ছে। সবগুলোর পেছনেই যুক্তি আছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পেছনেও যুক্তি আছে, জাতীয় নির্বাচনের পেছনেও যুক্তি আছে, ছাত্রসংসদ নির্বাচনের পেছনেও যুক্তি আছে। কিন্তু দেখতে হবে অগ্রাধিকার (প্রায়োরিটি) আসলে কোনটা। সরকারকে আমরা বারবার বলেছি যে আপনারা রোডম্যাপ দিন। রোডম্যাপ দিলে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারল। আর সাধারণ জনগণের যে ইনস্টিটিউশনগুলো, যে প্রতিষ্ঠানগুলো সেগুলোও প্রস্তুতি নিতে পারল। সরকার যেহেতু কোনো ক্লিয়ার ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে না, সেহেতু সবাই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এজন্য সরকারকে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দেওয়া উচিত।

কালবেলা: গণদাবি থাকা সত্ত্বেও ছাত্রসংসদ নির্বাচন হচ্ছে না কেন, আপনার কী মত?

উমামা ফাতেমা: প্রশাসন শুধু ছাত্র সংগঠনগুলোকে টপিক ভাবে। ছাত্র সংগঠনগুলো একটা স্টেকহোল্ডার, কিন্তু যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আছে, তারা তো এখানে স্টেকহোল্ডার হিসেবে অ্যাপিয়ার হওয়ার কথা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় একটা সার্ভে করুক যে ছাত্ররা ছাত্রসংসদ নির্বাচন চায় কি চায় না। তাদের কাছে তো টুলস আছে। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে তারা সার্ভে করুক। সেটা না করে তারা শুধু ছাত্র সংগঠনগুলোর অ্যাপ্রুভালের ভিত্তিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে যাচ্ছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর স্টেক ভারী হবে এবং ছাত্র সংগঠনগুলোই নির্বাচন হতে দেবে না। এজন্যই আমি মনে করি, ছাত্র সংগঠন নির্বাচনগুলো আটকে আছে। গভর্নমেন্ট যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোকে সহযোগিতা না করে, তাহলে ছাত্রসংসদ নির্বাচন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

কালবেলা: জুলাই প্রোক্লেমেশন কেন হলো না, দায় কার?

উমামা ফাতেমা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে কিন্তু আমরা জুলাই প্রোক্লেমেশন দিতে চেয়েছিলাম ৩১ ডিসেম্বর। সরকারের আশ্বাসের ভিত্তিতেই কিন্তু আমরা এই প্রোক্লেমেশনটা পিছিয়েছি। এখন সরকার যদি কোনো সংলাপ ছাড়া প্রোক্লেমেশন থেকে চার্টারে (সনদ) মুভ করে, তাহলে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়বে। আর জুলাই তাহলে ইতিহাসে কী হিসেবে থাকবে। এটা কি মব ভায়োলেন্স হিসেবে থাকবে, নাকি অভ্যুত্থান হিসেবে থাকবে। এই সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিতে হবে।

কালবেলা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

উমামা ফাতেমা: কালবেলা এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ক্রিকেটারদের সঙ্গে বিসিবির ৩ ঘণ্টার বৈঠকে কী আলোচনা হল?

যুক্তরাজ্য থেকে আসবে ৩ কার্গো এলএনজি

২৫ মিলিয়ন ডলারের চুরি করা গোলাপি হীরা উদ্ধার দুবাই পুলিশের

খোলামেলা পোশাকে বিতর্কে পাকিস্তানি অভিনেত্রী আইজা

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও বাড়াতে চায় বাংলাদেশ

দেশজুড়ে মোবাইল কোর্ট অভিযানে ১২২০ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ

স্বামীর মৃত্যুদণ্ড জনসম্মুখে, স্ত্রীর দণ্ড হবে কারাগারে

এইচএসসি পাসে নিয়োগ দেবে সজীব গ্রুপ, লাগবে না অভিজ্ঞতা

টিসিএল পণ্য এখন বাজারজাত করছে মিনিস্টার-মাইওয়ান গ্রুপ

ডাকসু নির্বাচন / শেষ দিনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ৯৩ জনের, মোট ৬৫৮

১০

২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই বদলি কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও

১১

আব্দুল মজিদ মল্লিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে তেরখাদায় শিক্ষাবৃত্তি প্রদান 

১২

কক্সবাজারে মার্কিন নারীকে শ্লীলতাহানি, অতঃপর...

১৩

এসএসসি পাসেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চাকরির সুযোগ

১৪

গয়েশ্বর চন্দ্রের দুর্নীতি মামলার রায়ের দিন ধার্য

১৫

সংস্কার না করে পূর্বের নিয়মে নির্বাচন হতে পারে না : চরমোনাই পীর

১৬

ওমরাহ করে ফিরেছেন রইস উদ্দিন, সাক্ষাৎ করতে গেলেন অপু বিশ্বাস

১৭

কেউ টাকা ধার চাইলে সম্পর্ক ঠিক রেখে যেভাবে ‘না’ বলবেন

১৮

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা লড়াই করেছি : মো. শাহজাহান

১৯

৫৫ লাখ টাকা চুরির মামলায় গৃহকর্মী-দারোয়ান রিমান্ডে 

২০
X