পাহাড় বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোহিত হয় না এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। সেই টানেই প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদের ছুটিতে ভ্রমণপ্রেমীরা ছুটে যাচ্ছেন পার্বত্য জেলা বান্দরবানে। পরিবার-পরিজন নিয়ে পাহাড়ঘেরা পাথর-পানির খেলা, মেঘ আর পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্যপট দেখতে ভিড় করছেন নীলগিরি, নীলাচল, শৈলপ্রপাত ও মেঘলা পর্যটনকেন্দ্রে।
সকালে এসব কেন্দ্রে তুলনামূলকভাবে পর্যটকের সংখ্যা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ভিড়। কেউ চড়ছেন মেঘলার কেবল কারে, কেউবা ঝুলন্ত সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে দিচ্ছেন পোজ, বন্দি করছেন প্রিয় মুহূর্তগুলো ক্যামেরায়। শিশুদের দেখা যাচ্ছে দোলনায় আর বড়রা দলবেঁধে গান গাইছেন পাহাড়ি প্রকৃতির কোলে।
সরেজমিন দেখা যায়, ভোর থেকেই বান্দরবানের গাড়ি স্টেশনগুলোতে ভিড়। দরকষাকষি করে পরিবহন ভাড়া করছেন পর্যটকরা। নীলাচল ও মেঘলায় দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপচে পড়া ভিড়। পর্যটকরা কেউ ছবি তুলছেন, কেউ তাঁতের দোকানগুলোতে ভিড় করছেন। সৌখিন পণ্য ও তাঁতবস্ত্র কিনে নিচ্ছেন অনেকে। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্তের লাল আভাময় আকাশও ধরা পড়ছে অসংখ্য ক্যামেরার ফ্রেমে।
নারায়ণগঞ্জ থেকে পরিবারসহ ঘুরতে আসা ব্যাংকার জাকিয়া সুলতানা বলেন, ‘এই প্রথম বান্দরবানে এলাম। ঢাকায় থেকে এ সৌন্দর্য কল্পনাও করা যায় না। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে।’
মেঘলায় ঘুরতে আসা কামাল হোসেন বলেন, ‘অনেক গরম, পাহাড়গুলো রুক্ষ, তবু সবদিক থেকেই সুন্দর।
চারদিকে শুধু পাহাড় আর আঁকাবাঁকা পথ—অসাধারণ অভিজ্ঞতা।’
হোটেল-মোটেলে ঠাঁই নেই, অনেকে রাত কাটিয়েছেন গাড়িতে: জানা গেছে, ৫ এপ্রিল পর্যন্ত বান্দরবানের সব হোটেল-মোটেল সম্পূর্ণ বুকড। অনেক পর্যটক হোটেল কক্ষ না পেয়ে বাধ্য হয়ে গাড়িতেই রাত কাটিয়েছেন।
ফেনী থেকে আসা জামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা ২০ জনের একটি দল নিয়ে এসেছি; কিন্তু কোথাও থাকার জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে গাড়িতে রাত কাটাতে হয়েছে। আমাদের মতো অনেকের একই অবস্থা।’
হিলভিউ হোটেলের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ পারভেজ জানান, ‘আমাদের ৮৫টি কক্ষ একেবারে পূর্ণ। চাঁদরাত থেকেই বুকিং শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন প্রায় ৩০০ জন পর্যটক থাকতে পারলেও চাহিদা তার চেয়ে বেশি।’
পরিবহনে চাপ ও টিকিট সংকট: সেন্টমার্টিন পরিবহনের ম্যানেজার আবিদুল ইসলাম জানান, ‘৩ ও ৪ এপ্রিল বান্দরবানগামী সব বাস আগাম বুকিং হয়ে গেছে। প্রচুর চাপ রয়েছে।’
ঢাকা পরিবহন সমিতির সভাপতি কামাল পাশাও বলেন, ‘৩-৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা-বান্দরবান রুটে কোনো সিট ফাঁকা নেই।’
পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার আশ্বাস প্রশাসনের: বান্দরবান ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার নিত্যানন্দ দাস বলেন, ‘ঈদকে কেন্দ্র করে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশ ও জেলা পুলিশ যৌথভাবে কাজ করছে।’
জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি জানান, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। দেবতাখুম পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানকার পরিস্থিতি আমরা পর্যবেক্ষণে রাখছি।’
তবে প্রশাসনের মতে, রুমা ও থানচির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক নয়, ফলে সেখানে বিধিনিষেধ বহাল রয়েছে। কেএনএফ তৎপরতার কারণে এই এলাকাগুলোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।
কেনাকাটা ও ভিসা জটিলতায় পর্যটকদের গন্তব্য বদল: পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, ‘ভারতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিসা জটিলতা থাকায় এবার অনেক মধ্যবিত্ত পর্যটক বান্দরবানমুখী হয়েছেন। হোটেলগুলো ৬ এপ্রিল পর্যন্ত শতভাগ বুকড। এই চাপ ব্যবসায়ীদের জন্য লাভজনক হচ্ছে।’
বান্দরবান রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতের বদলে এবার বান্দরবান ঘুরতে এসেছেন অনেকে। আমরা পর্যটকদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। এই মৌসুমে আগের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারব।’
মন্তব্য করুন