কুমিল্লার হোমনা উপজেলা সদর থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে তিতাস নদীর পাড়ে শ্রীমদ্দি গ্রাম। এ অঞ্চলের মানুষ গ্রামটিকে চেনে বাঁশির গ্রাম হিসেবে। বাংলা নববর্ষ সামনে রেখে গ্রামের বাঁশিপল্লিতে এখন দিনরাত ব্যস্ততা। তবে এই গ্রামের বাঁশি দেশ ছাড়িয়ে এখন রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
সম্প্রতি শ্রীমদ্দি গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামের প্রায় সব বাড়ি দোচালা। প্রতিটি বাড়ির আঙিনাসহ এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন রকমের বাঁশি। নারী-পুরুষ-শিশুসহ সবাই বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত। কেউ বাঁশ কাটছেন, কেউ বাঁশি তৈরি করছেন, কেউ বা একে ঘষে করছেন মসৃণ। তবে বাঁশিতে নকশা তৈরি, ছিদ্র করা, ধোয়া-শুকানো এবং রং করার কাজে নারীরাই বেশি দক্ষ।
এখান থেকেই বিভিন্ন নকশা ও আকৃতির বাঁশি চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় বাজারে। কারিগর জজ মিয়া (৪৫) বলেন, দৈনিক আমরা একশ বাঁশি তৈরি করি। এ গ্রামে বাঁশি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে কবে, তা তিনি সঠিকভাবে বলতে পারেন না। তবে জানান, তাদের দাদা-বড় দাদার আমল থেকেই বাঁশি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। সেই থেকে বংশপরম্পরায় এই বাঁশিশিল্পের সঙ্গে তারা জড়িত।
ফাল্গুন থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত বেশি বাঁশি তৈরি ও বিক্রি হলেও শ্রীমদ্দি গ্রামের শিল্পীরা সারা বছরই বাঁশি তৈরি করেন। দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন এসে পাইকারি দরে বাঁশি কিনে নিয়ে যান।
কারিগর আবুল কাশেম (৬০) বলেন, এই গ্রামে একশ থেকে দেড়শ বছর ধরে চলছে বাঁশি তৈরির কাজ।
পূর্বসূরিদের দেখানো পথে এখনো অর্ধশত পরিবার এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই গ্রামের বাঁশি ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৫-২০টি দেশে খ্যাতি ছড়িয়েছে। তিনি বলেন, দেশের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ বাঁশি তৈরি হয় এই শ্রীমদ্দি গ্রামেই।
এখানে প্রায় ১৫ ধরনের বাঁশি তৈরি হয়। এগুলোর মধ্যে তোতা (মুখ) বাঁশি, মোহন বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি, খানদানি বাঁশি, আর বাঁশি (ক্ল্যাসিক্যাল সুরের বাঁশি), বীণ বাঁশি, বেলুন বাঁশি রয়েছে। একেবারেই প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই বাঁশির কদর ও সুনাম রয়েছে।
শ্রীমদ্দি গ্রামের সবচেয়ে দক্ষ কারিগর যতীন্দ্র বিশ্বাস ও তার স্ত্রী রিনা বিশ্বাস। তাদের দুজনের তৈরি করা নকশি বাঁশি চলে যায় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এ ছাড়া সারা বছরই হোমনার মিরাশের মেলা, শ্রীমদ্দি কালীবাড়ির মেলা, দাউদকান্দির আইনুদ্দিন শাহ মেলা, কচুয়ার সাচারের ও ধামরাইয়ের রথমেলা, মতলবের বেলতলীর লেংটার মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খরমপুরের মেলা, চট্টগ্রামের জব্বারের বলী খেলা, লাঙ্গলবন্দের অষ্টমী স্নান, সাতক্ষীরার পূজার মেলা, কুষ্টিয়ার লালন শাহ মেলা, তিতাসের গাজীপুরের মেলায় বাঁশি বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। বৈশাখী মেলায়ও প্রচুর বাঁশির চাহিদা রয়েছে।
বাঁশির আরেক কারিগর অনিল বিশ্বাস জানান, ১০-১২ বছর বয়স থেকেই এ কাজ শুরু করেছেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাই না। আমাদের মূলধন সংকট রয়েছে। সরকার সুদমুক্ত ব্যাংক ঋণ দিলে আমরা এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব।
মন্তব্য করুন