সঞ্জয় ঘোষ
প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:২৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চিরনির্বাসনেই চলে গেলেন কবি দাউদ হায়দার

চিরনির্বাসনেই চলে গেলেন কবি দাউদ হায়দার

‘আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ/ আহা দুঃখ/ দুঃখরে!/ আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।’—কবি দাউদ হায়দারের বিখ্যাত কবিতা ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’-এর শেষ ছত্র এটি। গত ২৬ এপ্রিল শনিবার রাতে, জার্মানির স্থানীয় সময় রাত ৯টা ২০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি।

একটি কবিতার জন্য দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে যাওয়া কবি দাউদ হায়দার এবার চলে গেলেন চিরনির্বাসনে। নিজ জন্মভূমিতে আর ফেরা হলো না তার। কবির নির্বাসন যেন আর শেষ হওয়ার নয়।

তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তিনি বার্লিনে অবস্থিত একটি বয়স্ক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর আগে ২০২৪ সালে ডিসেম্বরে সিঁড়িতে পড়ে তিনি মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন।

দাউদ হায়দারই বাংলাদেশের প্রথম কবি, যাকে কবিতা লেখার জন্য দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ওই কবিতায় হজরত মোহাম্মদ (সা.), যিশুখ্রিষ্ট এবং গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত অবমাননাকর উক্তি রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। শুরু হয় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে ঢাকার এক কলেজ শিক্ষক আদালতে দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।

তবে ৯ মার্চ দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত বিবৃতিতে দাউদ হায়দার কবিতাটির জন্যে ক্ষমা চেয়ে বলেন, ‘কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া কবির ইচ্ছা ছিল না। আল্লাহ রাসুল ও অন্য ধর্মের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। আমি এ কবিতাটি কোনো কাব্য গ্রন্থে যুক্ত করব না।’

ওই ঘটনায় তৎকালীন সরকার কবিকে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেয়। তারপর ’৭৪-এর ২০ মে সন্ধ্যায় জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ২১ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তাকে কলকাতা পাঠানো হয়। যে ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিলেন না। তার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তার কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটি ছোট ব্যাগ। ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দুই জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ।

গত বছরের ১২ ডিসেম্বর দুর্ঘটনার দিন প্রথমে বার্লিনের স্থানীয় রাইনিকেডর্ফ হাসপাতালে, পরে নয়েকোলন হাসপাতালে চিকিৎসা হয় কবি দাউদ হায়দারের। চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, আঘাতের কারণে তার মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তখন কবিকে দুই সপ্তাহ হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রেখে কৃত্রিমভাবে নল দিয়ে খাবার খাওয়ানো ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

চিকিৎসাধীন অবস্থায় শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে এবং জ্ঞান ফিরলেও তার তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যেত না তখন। পরে ‘কৃত্রিম কোমা’ থেকে সাধারণ কোমায় রেখে তার শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচার করা হয়।

গত জানুয়ারির শুরুতে কবিকে বার্লিন থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে গ্রাইফভাল্ডার শহরে নিউরোলজি বা স্নায়বিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। চিকিৎসকরা তখন জানান, সেখানে তাকে দীর্ঘদিন থাকতে হবে। কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে দাউদ হায়দারকে গত মার্চের প্রথম সপ্তাহে বার্লিনের শ্যোনেবের্গ ক্লিনিকে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই তার জীবনাবসান ঘটে।

নির্বাসিত হয়ে ভারতে অবস্থানকালে সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় দাউদ হায়দারকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়নের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। দাউদ হায়দারকে ভারত থেকেও বহিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৭ সালের ২২ জুলাই নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গুন্টারগ্রাসের সহযোগিতায় তিনি ভারত ত্যাগ করে জার্মানিতে আশ্রয় লাভ করেন। উল্লেখ্য, ভারত থেকে জার্মানি যাত্রায় পাসপোর্টের পরিবর্তে জাতিসংঘের বিশেষ ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছিলেন কবি দাউদ হায়দার।

দাউদ হায়দার ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনার দোহারপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, লেখক ও সাংবাদিক। শেষ জীবনে তিনি একজন ব্রডকাস্টিং সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বাংলা ভাষার একজন আধুনিক কবি; যিনি সত্তর দশকের কবি হিসেবে চিহ্নিত। তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে, ঢাকার একটি দৈনিকের রবিবাসরীয় সংখ্যায়। সত্তর দশকের শুরুর দিকে দাউদ হায়দার দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৩ সালে লন্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি দাউদ হায়দারের একটি কবিতাকে ‘দ্য বেস্ট পোয়েম অব এশিয়া’ সম্মানে ভূষিত করেছিল।

তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, ‘বেলাভূমে যখন হাঁটছিলাম, ঘটনার সূত্রপাত’, ‘সম্পন্ন মানুষ নই’, ‘নারকীয় ভুবনের কবিতা’, ‘যে দেশে সবাই অন্ধ’, ‘সংগস অব ডেস্পায়ার’, ‘এই শাওনে এই পরবাসে’, ‘সমস্ত স্তরে ক্ষতচিহ্ন’, ‘আমি পুড়েছি জ্বালা ও আগুনে’। ‘ইল্লিন ঝিল্লিন’ নামে তার আত্মজীবনীর প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আইআইইউসিতে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা শিক্ষার্থীদের ‎

সুখবর দিলেন পরিণীতি চোপড়া

আজ থেকে নতুন দামে রুপা বিক্রি শুরু, ভরি কত

হার্ট ভালো রাখতে কতটুকু ঘুম জরুরি জেনে নিন

এশিয়া কাপ: ফাইনালে উঠতে কোন দলের সামনে এখন কী সমীকরণ

মৃত্যুর পর যা রেখে গেলেন জুবিন গর্গ

সৌদির গ্র্যান্ড মুফতির মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক

৩০০ ফিট সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থী নিহত

ফুটবল খেলা নিয়ে দুই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ, আহত ১৭

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসে লাভ নেই, বরং ক্ষতি : খামেনি

১০

আ.লীগ নেত্রী ও কাউন্সিলর নার্গিস গ্রেপ্তার 

১১

মুস্তাফিজের প্রশংসা করে, বাংলাদেশকে সম্মান দিয়ে যা বললেন ভারতের সহকারী কোচ

১২

ছেলেকে বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ, ৩ দিন পর মায়ের মরদেহ উদ্ধার

১৩

ভারতকে উড়িয়ে ফাইনালের স্বপ্ন বুনতে পারবে টাইগাররা?

১৪

শিবগঞ্জের ৬২ পূজামণ্ডপ পেল তারেক রহমানের অনুদান 

১৫

পাকিস্তানে চলন্ত ট্রেনে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ

১৬

আজ বায়ুদূষণে শীর্ষে পাকিস্তানের লাহোর, ঢাকার অবস্থান কত? 

১৭

পিআর পদ্ধতিতে জনগণের প্রতিটি ভোটের মূল্য আছে : চরমোনাই পীর

১৮

স্কুল মাঠে ধানসহ মাছ চাষ, খেলাধুলা বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা

১৯

ঝাল মরিচ কি শরীরের জন্য খারাপ? জানুন বিশেষজ্ঞদের মতামত

২০
X