ছাত্র রাজনীতি শেষে বিএনপি তথা এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সংগঠনের পদে যুক্ত হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি তাদের যথার্থ মূল্যায়ন করেনি বলে অভিযোগ। ছাত্রদলের নেতাদের অভিযোগ—এক যুগের বেশি সময় ধরে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম আর কারাগারই তাদের ঠিকানা। বিশেষ করে বিগত সেনাসমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের সরকারের আমলে রাজনীতি করতে গিয়ে ছাত্রদলের বহু নেতাকর্মী ও তাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দলীয় পদ না থাকলেও বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে খ্যাত ছাত্রদলের সাবেক নেতারা সভা-সমাবেশে সক্রিয়। অবশ্য কেউ কেউ ক্ষোভে অভিমানে রাজনীতি থেকে দূরত্বে থেকে কেবল বড় ধরনের সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। এরই মধ্যে যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলেও অনেকেই পদবঞ্চিত হয়েছেন। সম্প্রতি বিএনপিতে কয়েকজন নেতার পদোন্নতি, ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারসহ নানা কারণে ভবিষ্যতে আশার আলো দেখছেন পদবঞ্চিত সাবেক ছাত্রনেতারা। তারা বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দলসহ অঙ্গ ও সংগঠনে যুক্ত হয়ে দলীয় কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে চান। এজন্য পদবঞ্চিত সাবেক ছাত্রনেতারা দলীয় পদ তথা সাংগঠনিক পরিচিতি চান। কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন বলেন, তাদের ২৩১ সদস্য কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন মারা গেছেন। সেগুলো পূরণ এবং কমিটির পরিধি নতুনভাবে বৃদ্ধি হতে পারে। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটিও বৃদ্ধি হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, গত ১৮ আগস্ট বিএনপির নির্বাহী কমিটির তিন সদস্যকে পদোন্নতি দেয় দলের হাইকমান্ড। নির্বাহী কমিটির সদস্য রাশিদুজ্জামান মিল্লাতকে দলের কোষাধ্যক্ষ করা হয়েছে। আগের কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সিনহা পদত্যাগ করায় পদটি দীর্ঘদিন ধরেই শূন্য ছিল। নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক এবং বজলুল করিম চৌধুরী আবেদকে সহ-পল্লি উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। জুয়েল এর আগে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ছাড়াও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর বজলুল করিম চৌধুরী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। এই তিন নেতার পদোন্নতির মধ্য দিয়ে সক্রিয় নেতাদের বিএনপির নির্বাহী কমিটির শূন্য পদ পূরণ শুরু হলো বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, বিএনপির স্থায়ী কমিটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলসহ জাতীয় নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তা-সদস্যসহ অন্তত ৪০টিরও বেশি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ নেতা মারা গেছেন, কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন। সবশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল হয়েছিল দেশের অন্যতম বড় এই রাজনৈতিক দলের। এরপর নির্বাহী কমিটি, স্থায়ী কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদ মিলিয়ে ৫৯২ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে কমিটিগুলোতে নতুন সদস্য যুক্ত হন। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে সদস্য রয়েছেন ৫০২ জন।
ছাত্রদলের ১১ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার
দীর্ঘ চার বছর পর গত ২৪ জুলাই ছাত্রদলের ১১ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে বিএনপি। তারা হলেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এজমল হোসেন পাইলট, ইখতিয়ার রহমান কবির, মামুন বিল্লাহ, জয়দেব জয়, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, বায়েজিদ আরেফিন, সহসাধারণ সম্পাদক দবির উদ্দিন তুষার, সহসাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আজম সৈকত, আব্দুল মালেক, সদস্য আজিজুল হক পাটোয়ারী আজিম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার সিদ্দিকী। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব নেতাকে নতুনভাবে বিএনপির নির্বাহী কমিটি বা অঙ্গ ও সংগঠনের কোনো পদে দেখা যেতে পারে বলে জানা গেছে। ২০১৯ সালের ২২ জুন ছাত্রদলের ১২ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের তখনকার সভাপতি জহির উদ্দিন তুহিনও ছিলেন। এরই মধ্যে তিনি স্বেচ্ছাসেবক দল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতির পদ পেয়েছেন।
যুবদলের কমিটিতে পদবঞ্চিত অনেকে
এদিকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সভাপতি ও আবদুল মোনায়েম মুন্নাকে সাধারণ সম্পাদক রেখে জাতীয়তাবাদী যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। ২০২২ সালের ২৭ মে আট সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণার ৯ মাসের মাথায় ২৫১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা দেয় যুবদল। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ২৬ জনকে সহসভাপতি, ২৫ জনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ২৫ জনকে সহসাধারণ সম্পাদক, ২৫ জনকে সহসাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়েছে ৭৫ জনকে; কিন্তু ওই কমিটিতে যুবদলের আগের কমিটির (নীরব-টুকু) অনেকেই বাদ পড়েছেন। এমনকি ছাত্রদলের রাজীব-আকরাম কমিটির অনেক নেতা পদবঞ্চিত হন। যে কারণে যুবদলের নবগঠিত কমিটিতে দুর্নীতি, পদবাণিজ্য, অযোগ্যদের পদায়ন এবং ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করার প্রতিবাদে পদবঞ্চিতরা নয়াপল্টনে লাগাতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি করেন। তারা যুবদলের কমিটি বাতিল এবং ত্যাগী কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। এমনকি বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কাছেও অভিযোগ দেন। একপর্যায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ বিষয়ে যুবদলের শীর্ষ নেতাদের পদক্ষেপ নেওয়ার আদেশ দেন; কিন্তু আট মাসেও তাদের পদায়ন করা হয়নি।
যুবদলের কমিটিতে পদবঞ্চিতরা হলেন সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আলি আশরাফ, কামাল উদ্দিন, সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিক, সামসুর রহমান, রফিকুল ইসলাম রতন, এস এম মিজান, সাবেক সহসাংগঠনিক সম্পাদক ওমর তাহের বাবু, সাবেক সদস্য শাহজাহান আলম শাহীন, সৈয়দ আবেদিন প্রিন্স, আহসান উল্লাহ তুষার ও রাসেল মিয়া। ছাত্রদলের রাজীব-আকরাম কমিটির নেতা তারেক উজ জামান, শোয়াইব খন্দকার, আশরাফুর রহমান বাবু, হুমায়ুন কবির, জাকির হোসেন খান, সাজ্জাদ হোসেন উজ্জ্বল, মিজানুর রহমান সোহাগ, আবুল হাসান, এবিএম মহসিন বিশ্বাস, কাজী মেজবাহুল আলম, সুমন চৌধুরী, কোয়েল হোসেন, রকিবুল হাসান হাওলাদার, শফিউল আজম, শহিদুল ইসলাম সরকার মাসুদ, খোরশেদ আলম, খন্দকার রিয়াজ, মাজেদুল ইসলাম মাসুম, রবিউল হাসান আরিফ, জিল্লুর রহমান কাজল, আবু জাফর রিপন, মশিউর রহমান রিয়াদ, নাজমুল হাই রায়হান, যুবদল ঢাকা মহানগর উত্তরের হাফিজুর রহমান শরিফ হাফিজ, ঢাকা জেলা যুবদলের ফজলুর রহমানসহ অনেকে।
তারেক উজ জামান তারেক কালবেলাকে বলেন, যারা এক যুগের আন্দোলন-কর্মসূচিতে কোনো ভূমিকা রাখেনি—এমন অনেককে পদ দেওয়া হয়েছে। যারা ত্যাগী, দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে সক্রিয় তাদের পদ দেওয়া হয়নি। বিএনপির হাইকমান্ড যুবদলের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশ দিলেও আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আবুল হাসান বলেন, ১০ বছর আগে ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক হয়েছি, এখনো পদোন্নতি নেই। উদ্ভট, মিথ্যা ও হাস্যকর অভিযোগে যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটি হতে বাদ পড়েছি শুনলাম। এভাবে পদ শূন্য থাকা লজ্জার ও অপমানের হলেও প্রতিটি মিটিং-মিছিলে আগের মতোই থাকছি।
স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটিতে ৩৬ পদ শূন্য
এ ছাড়া গত ২০ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের ২১৩ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এসএম জিলানীকে সভাপতি ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রাজীব আহসানকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি (আংশিক) ঘোষণা করা হয়েছিল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশক্রমে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কমিটি অনুমোদন করেন। ২৫১ সদস্যের মধ্যে ২১৩ সদস্যের নাম ঘোষণা করা হলো। বিভাগীয় পদসহ মোট ৩৬টি পদ পরবর্তী সময়ে ঘোষণা করার কথা থাকলেও, তা এখনো শূন্য। এ বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে শূন্যপদ পূরণে প্রক্রিয়া চলছে।
জানা গেছে, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটিতেও আগের কমিটির এবং ছাত্রদলের সাবেক অনেক নেতাকে পদায়ন করা হয়নি। ফলে যারা পদের আশায় দীর্ঘদিন ধরে রাজপথের কর্মসূচি সক্রিয়ভাবে পালন করছেন তারা আশায় আছেন। এই কমিটিতে পদবঞ্চিতরা হলেন ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের মধ্যে শহীদুল্লাহ ইমরান, আহসান উদ্দিন খান শিপন, আব্দুল হালিম খোকন, রাজীব-আকরাম কমিটির এজমল হোসেন পাইলট, মহিদুল হাসান হিরু, আব্দুল ওহাব, আহমেদ সাইমুম, জহিরুল ইসলাম বিপ্লব, মফিজুর রহমান আশিক, বায়েজীদ আরেফিন, সামসুল আলম রানা, মির্জা ইয়াসিন আলী, রাজিব আহসান চৌধুরী পাপ্পু, আমীর আমজাদ মুন্না, সঞ্জয় দে রিপন, আরজ আলী শান্তসহ অনেকেই।
সাবেক ছাত্রনেতাদের বিএনপি কীভাবে মূল্যায়ন করবে—জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, রাজনৈতিক দলের কমিটি গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। সাবেক ছাত্রনেতাদের মূল্যায়নের ব্যাপারে বিএনপির হাইকমান্ড খুবই ইতিবাচক। মূল দলসহ অঙ্গ সংগঠনের কমিটিতে তাদের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা হবে।
মন্তব্য করুন