জুলাই যোদ্ধাদের ওপর হামলার ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উচ্চপর্যায়ের নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনসহ জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তা চেয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সরকার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন দলটির নেতারা। গত ৪ মে গাজীপুরে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ হামলার শিকার হন। এর পরে জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তাসহ পাঁচ দাবিতে পরদিন সোমবার এনসিপির একটি প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দেয়। স্মারকলিপি দেওয়ার বিষয়টি কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন দলটির সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) রফিকুল ইসলাম আইনি।
তবে স্মারকলিপির মাধ্যমে জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তার দাবি সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তর কিছু জানে না। এ বিষয়ে জানতে কথা হয় পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলমের সঙ্গে। গত বুধবার কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই।’ জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তার বিষয়ে যে দাবি উঠেছে সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব কি না এবং এ বিষয়ে পুলিশের করণীয় কী—এমন প্রশ্নের জবাবে বাহারুল আলম বলেন, ‘এটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।’
স্মারকলিপির বিষয়ে কিছু জানেন না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু মমতাজ সাদ উদ্দিনও। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘স্মারকলিপি দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি দিয়ে থাকে, সেই অনুযায়ী অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত বছরের ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় সারজিস ও হাসনাতকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ ওঠে। এর পরদিন কুমিল্লা থেকে ঢাকায় ফেরার পথে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হাসনাতের গাড়ি। পরে ফেসবুকে তখনকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক (বর্তমানে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক) আবদুল হান্নান মাসউদ একটি স্ট্যাটাস দিয়ে তাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তোলেন। এ ছাড়া নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা বাজারে হান্নান মাসউদের পথসভায় হামলার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
হাসনাত, সারজিস ও হান্নান মাসউদের মতো সম্মুখ সারির জুলাই যোদ্ধাদের ওপর হামলার বিষয়গুলো নিয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ক্ষোভ জানিয়েছেন এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে জুলাই যোদ্ধাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। তাদের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে। যার ফলে বারবার এসব হামলার ঘটনা ঘটছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। নিরাপত্তা দিতে না পারলে এই সরকারের বিরুদ্ধেও আমরা আন্দোলন করব।’
কেমন হতে পারে নিরাপত্তা ব্যবস্থা?: জোরদার আইনের শাসন ও প্রয়োগই জুলাই যোদ্ধাসহ রাষ্ট্রের সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘আইনের কার্যকর প্রয়োগ হলেই এ ধরনের হামলা, আক্রমণ থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব। এজন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের (স্বরাষ্ট্র ও আইন উপদেষ্টা) শুধু বক্তব্য দিলেই হবে না। এ ধরনের ঘটনায় কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে।’ পুলিশি প্রটোকল ব্যবহার করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। সেটা খুব কার্যকর হবে না বলেও মনে করেন সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে জুলাই চেতনা ধারণ করে এমন মানুষদের পদায়নের পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘জুলাইতে যারা অবদান রাখেনি, যাদের দেখা যায়নি তারাই আজ দেশ পরিচালনা করছে। এ অবস্থায় জুলাই যোদ্ধারা কীভাবে নিরাপত্তা পাবে। তারা তো জুলাইয়ের পক্ষের লোক নয়, বেশিরভাগই নিরপেক্ষ লোক। তারা তো জুলাইকে ধারণ করবে না, স্বীকৃতি দেবে না। তাই এ অল্প সময়ের মধ্যে জুলাইয়ের অংশগ্রহণকারীরা হুমকির মুখে পড়ছে।’
হাসনাতকে পাঁচবার হত্যাচেষ্টার অভিযোগ: শুধু হাসনাত আব্দুল্লাহকেই দুবার হামলা ও তিনবার ‘গাড়িচাপা’ দিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। গত ৪ মে রাতে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় হামলার শিকার হন হাসনাত। তার গাড়ি লক্ষ্য করে ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল হামলা চালায়। এতে গাড়ির কাচ ভেঙে হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হন হাসনাত। ওই ঘটনায় সেদিন রাতেই একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে গাজীপুরের বাসন থানায়। এর পর কয়েক দফায় হামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে অন্তত ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর আগে গত ২৫ আগস্ট সচিবালয়ে আন্দোলনরত আনসার সদস্যদের হামলার শিকার হন বৈষম্যবিরোধী এই নেতা। এ ছাড়া চট্টগ্রামের আদালতে হামলায় নিহত অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের করব জিয়ারত শেষে ঢাকায় ফেরার সময়ও ট্রাকচাপা দিয়ে হত্যাচেষ্টা করা হয় হাসনাতকে। গত ২৭ নভেম্বরের ঘটনার দিন হাসনাতের সঙ্গে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আরেক নেতা সারজিস আলমও। সে ঘটনায় চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানায় একটি হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। এরপর অভিযুক্ত ট্রাকচালক ও তার সহকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঘটনার পরদিন ২৮ নভেম্বর সকালে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় ফেরার পথে হাসনাতকে বহন করা গাড়িতে মাতুয়াইল ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় আরও দুবার ট্রাকচাপা দিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে।
লোহাগাড়া থানায় দায়ের সেই মামলার বিষয়ে জানতে কথা হয় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইনের মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত সেই ট্রাকটি এখনো থানা হেফাজতে রয়েছে। শুনেছি তারা দুজনই জামিনে রয়েছেন।’ লোহাগাড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘শুনেছি ফেব্রুয়ারির দিকে তারা দুজন জামিনে বের হয়েছেন। এ ঘটনায় তাদের দুজনকে রিমান্ডে আনা হয়েছিল। সবকিছু তদন্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।’
জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের কার্যকরী ভূমিকা আবশ্যক বলে মনে করেন সেদিন গাড়িতে থাকা আরেক জুলাই যোদ্ধা সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘সরকার এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর এ ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা আবশ্যক। তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না বলেই এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।’
হান্নান মাসউদের ওপর বিএনপি ও ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ: অভ্যুত্থানের আরেক পরিচিত মুখ ও এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদকে অবরুদ্ধ করে হামলা চালানো হয়। গত ১১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে তাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করেছে—এমন অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া গত ২৫ মার্চে নিজ জেলা নোয়াখালীর হাতিয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মাধ্যমে হামলা শিকার হন মাসউদ। তবে এ ব্যাপারে তিনি কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। আইনি পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়ে হান্নান মাসউদ কালবেলাকে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুজনই জুলাই যোদ্ধাদের ওপর হামলা করছে। আমার ওপর বিএনপির নেতাকর্মীরা হামলা করেছে। তারা বলেছিল, তারা ব্যবস্থা নেবে, তাই আমি আইনিভাবে আগাইনি। কিন্তু তারা (বিএনপি) তাদের কথা রাখেনি।’
অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতারা যা বলছেন: জুলাই যোদ্ধাদের ওপর হামলার বিষয়টি নিয়ে অভিন্ন সুরে কথা বলছেন দেশের অন্যান্য ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের নেতারা। জুলাই যোদ্ধাদের ওপর হামলার বিষয়টিকে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। তিনি বলেন, ‘পুরো রাষ্ট্র অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। জনগণের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়নি, বরং ফ্যাসিস্ট আমলের প্রশাসনকে সরকার পুষছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই আন্দোলনে যারা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে এবং নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের টার্গেট করে হামলা করা হচ্ছে। এই সরকারের কারণেই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হচ্ছে, তারা হুমকি দিচ্ছে।’
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, ‘পতিত ফ্যাসিস্টদের বিচারের আওতায় আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতার কারণে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।’
মন্তব্য করুন