বরিশাল বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। বর্তমানে সেই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়েছে, রূপ নিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলায়। সম্প্রতি আত্মগোপনে থাকা এক যুবলীগ নেতার পক্ষে জমি দখল এবং উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে মহানগর ও জেলা বিএনপির নেতাদের মধ্যে ‘যুদ্ধংদেহি’ মনোভাব লক্ষ করা গেছে। এসব ঘটনার জেরে একই স্থানে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনসহ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। তারা বলছেন, মূলত বিএনপির কাউন্সিল ঘিরে একপক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করতে প্রকাশ্যে এমন দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে।
বর্তমানে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মনিরুজ্জামান খান ফারুক। এই কমিটির ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন ও সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার। এর মধ্যে মনিরুজ্জামান ফারুক ও জিয়াউদ্দিন সিকদার একাংশের এবং যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন নেতৃত্ব দিচ্ছেন আরেক অংশের। এ ছাড়া পদবঞ্চিত নেতাদের দুটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহানগর বিএনপির সাবেক দুই নেতা। তাদের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মজিবর রহমান সরোয়ার এক অংশের এবং মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ আরেক অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ চারজনই মহানগর বিএনপির শীর্ষ পদপ্রত্যাশী।
অন্যদিকে, বরিশাল জেলা দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও কমিটির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান এবং সদস্য সচিব আবুল কালাম শাহীন। তাদের বিপক্ষে পাল্টা বলয় তৈরি করেছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান রাজন। জেলা বিএনপির সভাপতি পদপ্রত্যাশী তিনি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের শেষ দিকে ঘোষণা করা হয় মহানগর বিএনপির তিন সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি। ওই সময় কমিটির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক এবং যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন ছিলেন এক গ্রুপের নেতৃত্বে। আর কয়েকজন যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যদের নিয়ে গ্রুপিংয়ে ছিলেন সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার। পরবর্তী সময়ে ফারুক ও নাসরিন গ্রুপে ফাটল ধরে। বিভক্ত হয়ে যান দুজন। বর্তমানে মনিরুজ্জামান ফারুক ও সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার মহানগর বিএনপির বৃহৎ একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন। তার সঙ্গে রয়েছেন কয়েকজন যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্য।
দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, মহানগর বিএনপিতে তিন নেতার গ্রুপিং ভাঙতে ঢাকা ও বরিশালে একাধিক বৈঠক করেছেন কেন্দ্রের নেতারা। কিন্তু প্রতিটি বৈঠকই নিষ্ফল হয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংয়ের কারণে কর্মী পর্যায়েও একে অন্যের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। বরং একপক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করতে মরিয়া হয়ে আছে।
সম্প্রতি মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহামুদুল হক খান মামুনের পক্ষে নগরীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে জমি দখলের অভিযোগ ওঠে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জসিম উদ্দিন খান, যুগ্ম আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান খান ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক (সাময়িক বরখাস্ত) মশিউর রহমান মঞ্জুর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধনও হয়েছে। তারা তিনজন মনিরুজ্জামান ফারুক গ্রুপের রাজনীতি করেন।
এর বিপক্ষে গত রোববার বিকেলে বরিশাল প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন অভিযুক্ত তিন নেতা। সেখানে তারা বলেছেন, জমি দখলের সঙ্গে তারা জড়িত নন। কোনো প্রমাণও কেউ দেখাতে পারবে না। মূলত, মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং মিথ্যাচার করছেন। তিনি নিজ দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন। তাদের দাবি, সামনে মহানগর বিএনপির কাউন্সিল। সেখানে জসিম উদ্দিন ও মাহফুজ খান নাসরিনের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই নাসরিন নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন।
যদিও প্রতিপক্ষের এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন আফরোজা খানম নাসরিন। তিনি বলেন, ‘যারা এই অভিযোগ দিচ্ছে আগেরও একটি অভিযোগে তাদের পদ স্থগিত করা হয়েছে, মামলা হয়েছে। যারা মামলার আসামি তারা প্রেস ক্লাবে গিয়ে কীভাবে সংবাদ সম্মেলন করে? সে তো (মশিউর রহমান মঞ্জু) মামলার আসামি, তার বিরুদ্ধে হাইকমান্ড ব্যবস্থা নিয়েছে, কেন্দ্র ব্যবস্থা নিয়েছে এবং তিন মাসের স্থগিতাদেশ আছে।’
এদিকে, জমি দখলের ঘটনায় জড়ানোর প্রতিবাদে গত সোমবার বেলা ১১টার দিকে নগরীর সদর রোডে মহানগর বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি আয়োজন করা হয়। একই সময় একই স্থানে ৩১ দফার লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করেন আফরোজা খানম নাসরিন। এ নিয়ে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে দলীয় মহলে। তা ছাড়া মঙ্গলবার সকালেও মহানগর বিএনপির দুই নেতা এবং মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের পদ স্থগিত নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন নাসরিন অনুসারী ছাত্রদলকর্মী পরিচয় দেওয়া মেহেদী হাসান নামের এক যুবক। তিনি অভিযোগ করেন, ওই তিন নেতা যুবলীগ নেতা খান মামুনের পক্ষে তাদের পৈতৃক জমি দখল করতে গিয়েছিলেন। তখন স্থানীয়দের ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে আসেন তারা।
এদিকে, মহানগরের পাশাপাশি জেলা বিএনপিতেও থেমে নেই বিশৃঙ্খলা। সম্প্রতি বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ জেলা বিএনপির বিরুদ্ধে মানববন্ধন এবং বিক্ষোভ করেছেন পদবঞ্চিতরা। এর নেতৃত্ব দেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান রাজন। তিনিসহ তার অনুসারীরা অভিযোগ করেন, অর্থের বিনিময়ে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান ও সদস্য সচিব আবুল কালাম শাহীন বাকেরগঞ্জ উপজেলায় পকেট কমিটি গঠন করেছেন। এর আগেও দক্ষিণ জেলা বিএনপির বর্তমান নেতাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ করেন রাজন অনুসারীরা। তারা আবুল হোসেন ও আবুল কালাম শাহীনের কমিটি ভেঙে দিয়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানান।
সার্বিক বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বরিশাল বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে অভ্যন্তরীণ বিরোধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। কিন্তু মহানগর কমিটিতে যা হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে হাইকমান্ড অবগত। তারা বিষয়টি দেখবেন।’
কমিটি গঠন নিয়ে জেলা বিএনপিতে দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিভাগের সাংগঠনিক প্রধান আব্দুল আউয়াল মিন্টু সাংগঠনিক সাতটি জেলায় ছয়জন কর্মমুখী তরুণকে দায়িত্ব দিয়েছেন। ভুলত্রুটি দেখার জন্য তারা আছেন। তা ছাড়া বিষয়টি নিয়ে আলী হায়দার লেলিন কাজ করছেন। কমিটি নিয়ে কোনো আপত্তি থাকলে সেটা নিয়ে আমরা কাজ করব, সমস্যা নিরসন করব। এটা নিয়ে মিছিল-মিটিং করার প্রয়োজন নেই। তারপরও আন্দোলন এবং দাবি তোলা তাদের অধিকার। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব। দাবি ন্যায্য হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মন্তব্য করুন