পরিবার পরিজন ছেড়ে, জন্মভূমি ছেড়ে মানুষ প্রবাসে যান ভাগ্য বদলের আশায়। বিদেশে গিয়ে কাজ করবেন, কিছু বেশি পারিশ্রমিক পাবেন এবং পরিবার ভালো থাকবে—এটুকুই তো চাওয়া। আর এই চাওয়াটুকু সামনে নিয়েই প্রতিবছর শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে যান অনেক বাংলাদেশি। তবে সৌদিতে যাওয়া এই বাংলাদেশিদের অনেকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটছে সৌদি নিয়োগকর্তাদের গাফিলতি ও নিষ্ঠুর আচরণের কারণে।
শুধু বাংলাদেশি নয়, ভারত-নেপাল ও অন্যান্য দেশ থেকে সৌদিতে যাওয়া অনেক শ্রমিকই প্রতিবছর মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। যেখানে বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখা গেছে- বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু, সড়ক দুর্ঘটনায় কিংবা উঁচু স্থান থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) ও ফেয়ার স্কয়ার-এর ১৪ মে প্রকাশিত এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি নিয়োগকর্তাদের গাফিলতি ও নিষ্ঠুর আচরণের কারণেই এসব মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটছে। অথচ এসব মৃত্যুগুলো চাইলেই হয়ত এড়ানো যেত। কর্মীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ না করার কারণেই শ্রমিকরা শিকার হচ্ছেন মর্মান্তিক মৃত্যুর।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ফেয়ার স্কয়ার এমন অনেক মৃত্যুর বিস্তারিত তদন্ত করেছে। যেখানে তারা এসব মৃত্যুর পেছনে অবহেলা খুঁজে পেয়েছেন। তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, অনেক ঘটনায় মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আড়াল করা হয়, যথাযথ তদন্ত না করে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ফলে পরিবারগুলো সৌদি আইনের অধীনে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ হারায়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও জানায়, অনেক পরিবার জানতে পারেনি তাদের স্বজনের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ। এমনকি কাজের সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও সেসব ‘অকাজজনিত মৃত্যু’ বলে চালানো হয়েছে। ফলে পরিবারের সদস্যরা বঞ্চিত হয়েছেন ন্যায্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ থেকে।
খবরে বলা হয়, বিশ্বকাপ ঘিরে সৌদি আরব ইতোমধ্যে বড় ধরনের নির্মাণ প্রকল্প শুরু করেছে। ২০৩৪ সালে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন স্টেডিয়ামসহ নানা অবকাঠামো। মানবাধিকার সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে, এসব প্রকল্পে আরও অনেক প্রবাসী শ্রমিক প্রাণ হারাতে পারেন যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হয়।
সৌদি ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নের চাপেও শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ন্যায্য পারিশ্রমিক, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সৌদি কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের পরিচালক মিনকি ওর্ডেন বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, ‘শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সৌদি আরব ও ফিফার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা এ দায়িত্ব এড়াতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের সময় নিরাপত্তা ও শ্রমিকদের সুরক্ষা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে পদক্ষেপ নিয়েছিল। সেখানে একটি সুপ্রিম কমিটি গঠন করা হয়েছিল, শ্রমিকদের জন্য জীবন বীমা চালু করা হয়েছিল এবং তাপদাহ থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু সৌদি আরব এখনো সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বিশ্বকাপ আয়োজনের গৌরবের পেছনে যেন আর কোনো শ্রমিকের রক্ত না ঝরে—এটাই এখন আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর জোর দাবি। তারা আরও বলছেন, সৌদি আরবের মতো প্রবাসী শ্রমিক নির্ভর দেশগুলোর উচিত মানবাধিকারকে সম্মান দিয়ে হলেও শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।
মন্তব্য করুন