নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান নূর ইসলাম। পড়াশোনা শেষ করে শখের ফটোগ্রাফিকে নিয়েছিলেন পেশা হিসেবে। বিয়ে, গায়েহলুদ, জন্মদিনসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ছবি তোলার কাজ করতেন। উপার্জন ভালো হওয়ায় পরিবারেও ফিরেছিল সচ্ছলতা। কিন্তু এই ছবি তোলা যে জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে—সেটি হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি নূর। গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে ছবি তোলার কথা বলে তাকে ডেকে নিয়ে যায় একটি চক্র। এরপর নির্জন জায়গায় নিয়ে চাপাতির ভয় দেখিয়ে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে চায় ওই দুর্বৃত্তরা। নিজের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন সেই শখের ক্যামেরা ছিনতাইয়ে বাধা দিলে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। গত শুক্রবার রাত ৮টার দিকে ধানমন্ডির শংকর জাফরাবাদ এলাকার মুচিপাড়া গলিতে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্বৃত্তরা এত নৃশংসভাবে নূরকে কোপাচ্ছিল যে সেটি দেখে স্থানীয় এক নিরাপত্তাকর্মী অচেতন হয়ে যান। রক্তে ভেসে যায় রাস্তা। কোপানোর সময় নূরের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলেও কেউ তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাননি। কারণ দুর্বৃত্তদের সবার হাতে ছিল ধারালো বড় বড় চাপাতি। স্থানীয় একটি বাসার কেয়ারটেকার জানান, শুক্রবার রাত ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তরা চলে গেলে মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে চিকিৎসক নূরকে মৃত ঘোষণা করেন। যে বাসার সামনে কোপানো হয় সেখানে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। যারা কুপিয়েছে তাদেরও এ এলাকার কেউ চেনেন না।
নিহত নূরের বন্ধু মো. ইমন কালবেলাকে জানান, ঘটনার সময় তিনিও নূরের সঙ্গে ছিলেন। তারা দুজন মিলে কথিত ওই গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। দুর্বৃত্তরা তার ক্যামেরাটিও ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু তিনি দৌড় দিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন বলে রক্ষা পেয়েছেন। ইমন জানান, তার বাসা মতিঝিল। দুই আড়াই বছর ধরে ফটোগ্রাফিতে সম্পৃক্ত। নূর আর তিনি বন্ধু হওয়ায় প্রায়ই দুজন একসঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছবি তুলতেন। বুধবার নূর তাকে ফোনে জানায়, শুক্রবার সন্ধ্যায় শংকর এলাকায় একটি গায়েহলুদের অনুষ্ঠান আছে, সেখানে ছবি তোলার কাজ পেয়েছেন। যেহেতু নূরের বাসাও শংকর, তাই তারা সহজেই রাজি হয়ে যান। নূরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৫০০ টাকা অগ্রীমও পাঠায় বিকাশের মাধ্যমে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ইমন বলেন, ‘শুক্রবার দুপুরে নূর রমনা এলাকায় আরেকটি অনুষ্ঠানে ছবি তুলতে গিয়েছিল। আমাদের ওই গায়েহলুদের প্রোগ্রামে সাড়ে ৬টায় যাওয়ার কথা থাকলেও নূর ৭টায় পৌঁছায়। এরপর আমরা শংকর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অপেক্ষা করতে থাকি। কিছুক্ষণ পর একজন আমাদের প্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসে। একটি অটোরিকশায় উঠে আমরা রওনা দিই। ওই লোক সামনে এবং আমরা পেছনে বসে ছিলাম। দুই-তিন মিনিট যাওয়ার পরই একটা গলিতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে চার থেকে পাঁচজন এসে আমাদের রিকশা ঘিরে ধরে। তাদের সবার হাতে বড় বড় ধারালো চাপাতি ছিল। ঘটনা আঁচ করতে পেরে আমি আর নূর দুজনই দৌড় দিই। আমি পেছন দিকে দৌড় দিই আর নূর সামনের দিকে। এ সময় কয়েকজন এসে আমার ক্যামেরার ব্যাগ ধরে ফেলে এবং কোপ দিতে উদ্যত হয়। তখন আমি ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে দৌড় দিয়ে পালাই।’
হামলার শিকার হওয়ার পর আশপাশের দোকানে আশ্রয় নিতে চাইলে আশ্রয় দেওয়া হয়নি জানিয়ে ইমন বলেন, ‘এরপর আরও কিছুটা দূর গিয়ে আমি আমার বন্ধুদের এবং নূরের দুলাভাইকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানাই। এরপর তারা এলে সবাই মিলে ওই গলিতে গিয়ে দেখি নূর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এরপর হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে আমার বন্ধু মারা যায়। আমি শুধু কপালের কারণে বেঁচে গেছি, আমার বন্ধুটা বাঁচল না। আমাদের দুজনের কাছে যে ক্যামেরা ছিল তার দাম ৫ লাখ টাকা। এই ক্যামেরার লোভেই আমার বন্ধুকে তারা হত্যা করল।’
নিহত নূরের ভাই ওসমান গনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে শংকর এলাকায় বসবাস করি। যারা এ কাজটি করেছে তারা পরিকল্পনা করেই করেছে। আমাদের ধারণা, আমার ভাই ওই দুর্বৃত্তদের চিনে ফেলেছিল। এজন্য তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই।’
ঘটনার বিষয়ে হাজারীবাগ থানার ওসি সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা জেনেছি ছবি তোলার কথা বলে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যারা এ হত্যার সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
মন্তব্য করুন