জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষ ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। ট্রায়ালের (বিচারের) যে কোনো পর্ব আদালতের অনুমতিক্রমে সরাসরি কিংবা রেকর্ডকৃত পদ্ধতিতে গণমাধ্যমে কিংবা সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হতে পারবে। গতকাল মঙ্গলবার চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এক ফেসবুক পোস্টে এ তথ্য জানান। বিচারের স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং যারা ট্রাইব্যুনালে আসতে পারবেন না, তারা যেন বিচার কার্যক্রম দেখতে পারেন, সেজন্য ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে এটি সরাসরি সম্প্রচার করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম।
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টে গুরুত্বপূর্ণ ও সাংবিধানিক প্রশ্ন সম্পর্কিত মামলার শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করা প্রশ্নে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি করে গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি মো. হাবিবুল গনি ও বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তাজরুল হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল দেন। রুলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জনগুরুত্বপূর্ণ ও সাংবিধানিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ মামলাগুলো কেন সরাসরি সম্প্রচার করা হবে না, তা জানতে চেয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ও সচিব ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
‘জুলাই গণহত্যার বিচার সরাসরি প্রচার’ : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে জুলাই গণহত্যার বিচার কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে জুলাই গণহত্যার ঘটনায় করা দুটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে এ-সংক্রান্ত তদন্ত সংস্থা। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখারপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের গুলিতে শিক্ষার্থী আনাস হত্যার ঘটনায় আটজনকে অভিযুক্ত করে ট্রাইব্যুনালে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া জুলাই গণহত্যায় সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) সংক্রান্ত একটি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। শিগগির এসব প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে দুটি ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। এজন্য ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষ প্রস্তুত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চিফ প্রসিকিউটর সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেন।
পরে প্রসিকিউটর গাজী এইচ এম তামিম এ বিষয়ে এক বার্তায় সাংবাদিকদের জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চলমান বিচারকার্য আরও গতিশীল, স্বচ্ছ এবং সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১৯৭৩ সালের আইনে গত বছর সংশোধনী আনা হয়। তার মধ্যে অন্যতম একটি সংশোধনী ছিল ট্রাইব্যুনালে যে বিচারকার্য চলবে, তা ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে রেকর্ড করা যাবে এবং তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা যাবে। আজকে (গতকাল) সেই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে সেটআপ দরকার, সাউন্ড সিস্টেম, ক্যামেরাসহ সব ধরনের ডিজিটালাইজেশনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন ট্রাইব্যুনালের এজলাসে যে বিচারকার্য হবে, তা ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে পাবলিকলি সম্প্রচার করা যাবে অথবা রেকর্ড করে পরবর্তী সময়ে ট্রাইব্যুনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের সাক্ষীদের নিরাপত্তার একটি বিষয় থাকবে। যার কারণে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে কথাটা বারবার বলা হচ্ছে। আইনেও ট্রাইব্যুনালের অনুমতির কথা বলা আছে। যার কারণে, ট্রাইব্যুনাল যদি কোনো ভিকটিম বা সাক্ষীর জন্য ঝুঁকি মনে করেন, তাহলে সেই সাক্ষী বা ভিকটিমকে না দেখিয়ে শুধু তার বক্তব্য প্রচার করতে পারবেন। অথবা ট্রাইব্যুনালের কোনো কার্যক্রম যদি ঝুঁকি মনে করেন, তাহলে সেই অংশটুকু প্রচার করতে পারবেন, সেজন্য ট্রাইব্যুনালের অনুমতির এখতিয়ার এখানে রাখা হয়েছে।
এদিকে তাজুল ইসলামের পোস্ট শেয়ার করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এক ফেসবুক পোস্টে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ব্যারিস্টার কাজল লিখেছেন, পুরো বিচার প্রক্রিয়াটি সরাসরি সম্প্রচার করা উচিত। এতে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। বিচার নিয়ে অপপ্রচার বন্ধ হবে। বিচারকের অনুমতিক্রমে সম্প্রচার করার বিধান করা হলে, বিচারকরা বিতর্কিত হতে পারেন। কোন অংশটুকু সম্প্রচারযোগ্য, তা নির্ধারণ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া এত বড় একটা বিচার তো স্বচক্ষে দেখার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সব আদালতের বিচারকাজ সরাসরি সম্প্রচার করা উচিত। এতে বিচার বিভাগের দুর্নীতি কমে যাবে। টাউট উচ্ছেদ হবে। আইনজীবীদের দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে। আইন পেশার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বাড়বে।
‘সুপ্রিমকোর্টে লাইভ সম্প্রচার কেন নয়’
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের জনগুরুত্বপূর্ণ ও সাংবিধানিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ মামলাগুলো কেন সরাসরি সম্প্রচার করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালতে এই রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তাকে সহযোগিতা করেন আইনজীবী মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন। এর আগে গত ২৭ জানুয়ারি এই রিট করা হয়। রিটকারীরা হলেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন, মিজানুন হক, আব্দুল্লাহ সাদিক, আমিনুল ইসলাম শাকিল, জজ কোর্টের আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র শাহনেওয়াজ সাকিব, মাহমুদুল হাসান, সাব্বির হাসান, হাবিবুর রহমান আল হাসান, রাফিউর রাব্বি ও শামিম শাহিদি। আদালত আগামী ২৬ জুন পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন।
রিটের পর রিটকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, তথ্য জানার অধিকার আইন দ্বারা স্বীকৃত। স্বচ্ছ বিচার পাওয়া সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ মামলাসমূহ লাইভ স্ট্রিমিং করা হয়। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫ অনুযায়ী স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক বিচার একটি মৌলিক অধিকার। তাই সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ মামলার লাইভ স্ট্রিমিং চেয়ে রিটটি করা হয়।
মন্তব্য করুন