১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলকে বিলুপ্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আর দেশের গণমাধ্যমকে তদারকির পাশাপাশি ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য একটি কমিশনের খসড়া প্রস্তুত করে মতামতের জন্য ১৮টি মন্ত্রণালয়-বিভাগ ও অন্যান্য দপ্তর সংস্থায় পাঠিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। মতামতের পর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং সাপেক্ষে তা অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপর তা অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করবে সরকার। সচিবালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গণমাধ্যম কমিশনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বিদ্যমান প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর সীমাবদ্ধতা ও সক্ষমতার অভাবে ওই আইনের কার্যকারিতা হারিয়েছে। গণমাধ্যমের রূপান্তর ও অভাবনীয় বিকাশের কারণে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, সুরক্ষা, মান ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন আইন প্রণয়নের আবশ্যকতা তৈরি হয়েছে। এজন্য প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে প্রেস কাউন্সিল বিলুপ্ত হলেও এর সব স্থাবর-অস্থাবর ও জনবল অর্থাৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমিশনেই কাজ করবেন। তাদের নিয়োগবিধিও আগের মতোই থাকবে। কমিশনপ্রধানের পদনাম হবে চেয়ারম্যান।
খসড়া পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি গণমাধ্যম কমিশনের অধ্যাদেশ জারি করবেন।
খসড়ায় বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশ বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ নামে অভিহিত হবে।
খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী, গণমাধ্যম বলতে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন সংবাদমাধ্যম ও সংবাদ সংস্থা এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে পরিচালিত বাংলা, ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্যাটেলাইটভিত্তিক বা ইন্টারনেটভিত্তিক কোনো রেডিও, টেলিভিশন বা অনলাইন মাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত স্থির ও চলমান চিত্র, ধ্বনি, লিখা, গ্রাফিক্স বা মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে উপস্থাপিত তথ্য, উপাত্ত সংবলিত কোনো সংবাদ বা বিজ্ঞাপন বা অনুষ্ঠান বা আধেয় প্রচার, প্রকাশও সম্প্রচারকারী বাংলাদেশে নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত কোনো সংবাদমাধ্যম বা সংবাদ সংস্থা বা বাংলাদেশের বাহিরে অবস্থিত বাংলাদেশি দর্শক ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে প্রচার, প্রকাশ ও সম্প্রচারকারী কোনো সংবাদমাধ্যম বা সংবাদ সংস্থা বোঝাবে।
কমিশনের গঠন:
একজন চেয়ারম্যান ও আটজন সদস্যসহ মোট ৯ জনের সমন্বয়ে এই কমিশন গঠিত হবে। কমিশনের চেয়ারম্যান ও একজন নারীসহ তিনজন সদস্য সার্বক্ষণিক থাকবেন। তবে অন্যান্য সদস্য অবৈতনিক হবেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে চারজন নারী এবং উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কমপক্ষে একজন সদস্য রাখতে হবে। চেয়ারম্যান কমিশনের প্রধান নির্বাহী হবেন।
খসড়ায় বলা হয়েছে, কমিশন একটি সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন সংস্থা হবে এবং এর স্থায়ী ধারাবাহিকতা থাকবে। এ অধ্যাদেশের বিধানাবলি সাপেক্ষে, ইহার স্থাবর ও অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জনের অধিকারে রাখার ও হস্তান্তর করার ক্ষমতা থাকবে। যে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এই কমিশনের নামে মামলা করতে পারবেন। কমিশনও চাইলে কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের নামে মামলা কিংবা আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে।
কমিশনের একটি সাধারণ সিলমোহর থাকবে। এটি কমিশনের সচিবের হেফাজতে থাকবে। কমিশনের প্রধান কার্যালয় হবে রাজধানী ঢাকায়। কমিশন প্রয়োজনে দেশের যে কোনো স্থানে এর শাখা কার্যালয় স্থাপন করতে পারবে।
কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়া:
গণমাধ্যম কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হবে। তারা হলেন—প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, যিনি উহার সভাপতিও হবেন; বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) মনোনীত যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অথবা আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং সম্পাদকের যোগ্যতাসম্পন্ন সাংবাদিকতা পেশায় ধারাবাহিকভাবে অন্যূন ২০ বছর কাজ করছেন এমন একজন প্রতিনিধি থাকবেন। চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগের তারিখ থেকে চার বছরের জন্য স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য গঠিত কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা করবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।
কমপক্ষে দুজন সদস্যের উপস্থিতিতে বাছাই কমিটির কোরাম গঠিত হবে। বাছাই কমিটি চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সভায় উপস্থিত সদস্যগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে তিনজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে।
পদত্যাগ প্রক্রিয়া:
চেয়ারম্যান বা যে কোনো সদস্য রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিতভাবে পদত্যাগ করতে পারবেন। চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে কিংবা তার অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ পর্যন্ত কিংবা চেয়ারম্যান স্বীয় দায়িত্ব পালনে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে কমিশনের কোনো সদস্যকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া যাবে।
নিয়োগ অযোগ্য যারা:
যদি বাংলাদেশের নাগরিক না হন। আর্থিক দুর্নীতি বা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধে উপযুক্ত আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হলে। কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হলে, কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ ঘোষিত হলে, ধারা ৮(৩)-এ উল্লিখিত বাস্তবজ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন না হলে, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে স্বীয় দায়িত্ববহির্ভূত অন্য কোনো পদে নিয়োজিত হলে তিনি নিয়োগ পাবেন না। তবে শর্ত থাকে যে, অবৈতনিক সদস্যদের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।
বেতন ভাতা:
কমিশনের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারকের সমান বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পাবেন। আর কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারকের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য মতোই সুবিধাদি পাবেন। এ ছাড়া অবৈতনিক সদস্যরা কমিশনের সভায় যোগদানসহ অন্যান্য দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত হারে সম্মানী ও ভাতা পাবেন।
কমিশনের উদ্দেশ্য ও কাজ:
দেশের প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন গণমাধ্যম ও সংবাদ সংস্থার স্বাধীনতা এবং মান নিশ্চিত করবে কমিশন। বাংলাদেশে কর্মরত সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, সাংবাদিকতার মান ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন গণমাধ্যম ও সংবাদ সংস্থায় উত্তম চর্চা, শুদ্ধাচার, অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সংক্রান্ত নীতিমালা ও বিধিমালা প্রণয়ন করবে গণমাধ্যম কমিশন।
এ ছাড়া প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন গণমাধ্যম ও সংবাদ সংস্থার মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, কর্মচারী, শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট সবার জন্য গ্রহণযোগ্য আচরণবিধি প্রণয়নে সহায়তা করবে কমিশন। গণমাধ্যমে কর্মরত সংবাদকর্মীদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতেও সহায়তা দেওয়া হবে।
কমিশনের সম্পদ:
অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পত্তি এবং উক্ত সম্পত্তিতে বা উহা থেকে উদ্ভূত অন্য সকল অধিকার ও স্বার্থ, নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, বিনিয়োগ, সকল হিসাব বহি, রেকর্ড এবং অন্যান্য দলিল কমিশনের নিকট হস্তান্তরিত এবং উহার ওপর ন্যস্ত হইবে। এ ছাড়া সকল ঋণ, দায় ও দায়িত্ব এবং উহার দ্বারা, উহার পক্ষে বা উহার সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি কমিশনের ঋণ, দায় ও দায়িত্ব এবং উহার দ্বারা, উহার পক্ষে বা উহার সহিত সম্পাদিত চুক্তি বলিয়া গণ্য হবে। প্রেস কাউন্সিলে বর্তমানে কর্মরত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীও গণমাধ্যম কমিশনের জনবল হিসেবে কাজ করবে।
মন্তব্য করুন