শিশু সুরক্ষা আইন লঙ্ঘন করে ১২ বছরের এক শিশুর বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় চুরির মামলা দিয়ে তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের ভুলে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে শিশুটিকে। এ ছাড়া মারধরের শিকার শিশুটির চিকিৎসা না করানো, গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টা পর আদালতে পাঠানো, এজাহার ও চালানপত্রে আসামির নাম ও বয়সে ভিন্নতাসহ শিশু আইনের পরিপন্থি নানা গুরুতর ত্রুটি দেখা গেছে। এ ঘটনায় খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাউদ হোসেন এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছেন আদালত। গত বুধবার ঢাকার শিশু আদালত-৩ এর বিচারক মো. গোলাম কবির এ আদেশ দেন। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তাদের আদালতে হাজির হয়ে এসব বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
শিশুটির বিরুদ্ধে মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, খিলগাঁও থানাধীন গোড়ান মাজার গলিতে বাপ্পি পরিবহন নামক গ্যারেজে কাজ করেন বাদী শুক্কুর আলী ও সিফাত হোসেন। গত ২৭ মে ভোরে মোবাইল ফোন চোর সন্দেহে দুই মেয়ে শিশু ও দুই তরুণীকে আটক করা হয়। পরে ৯৯৯-এ কল পেয়ে খিলগাঁও থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তাদের থানায় নিয়ে যায়। শুক্কুর আলী বাদী হয়ে এই চারজনের বিরুদ্ধে চুরির মামলা করেন। পরদিন বিকেলে আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়। এজাহারে এক নম্বর আসামির নাম রোকসানা (ছদ্মনাম) এবং বয়স ১৫ বছর থাকলেও আদালতে পুলিশ উল্লেখ করেছে তার নাম সোহানা, বয়স ১৪ বছর। এ ছাড়া আরেক শিশু রাফিজার (ছদ্মনাম) বয়স এজাহারের চেয়ে এক বছর বেশি ১২ বছর দেখানো হয়। গ্রেপ্তারের পরদিন ওই দুই শিশুকে কারাগারে পাঠানোর লিখিত আবেদনে আদালতকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার এসআই সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘শিশুদ্বয় এই মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। শিশুদ্বয় জামিনে মুক্তি পেলে পলাতক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের জেলহাজতে আটক রাখা একান্ত প্রয়োজন।’ আবেদনে এটাও উল্লেখ করা হয়, ‘আসামিরা পাবলিকের দ্বারা মারধরের শিকার হয়। শিশুদ্বয়ের সারা শরীরে নীলাফোলা জখম রয়েছে।’
এদিকে, মামলার এজাহার ও আসামি চালানপত্র পর্যালোচনা করে আইনপরিপন্থি বিভিন্ন ত্রুটি খুঁজে পান আদালত। যে ধারায় আইন ভঙ্গ করা হয়েছে, কারণ দর্শানোর নোটিশে সেটা উল্লেখ করেছেন বিচারক। তিনি বলেন, ‘দণ্ডবিধির ১৮৬০-এর ৮৩ ধারা অনুযায়ী ৯ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুর দ্বারা সংঘটিত অপরাধ, অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। যদি সে তার কার্যক্রমের প্রকৃতি ও পরিণতি বোঝার মতো পরিপক্বতা অর্জন না করে। আদালতে পাঠানো রাফিজা (ছদ্মনাম) নামে শিশুর বয়স এজাহারে ১১ বছর উল্লেখ রয়েছে।’ কেন তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করা হলো—জানতে চান বিচারক। এ ছাড়া থানায় কর্মরত শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা দিয়ে প্রয়োজনীয় মূল্যায়ন ও ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হয়নি, তারও ব্যাখ্যা জানতে চান আদালত।আরও বলা হয়, ‘এজাহারে উল্লিখিত ঘটনার সময় ২৭ মে তারিখের ভোর ৬টা ৫৫ মিনিট। স্থানীয় জনতা ঘটনার সঙ্গে জড়িত শিশুদের হাতেনাতে আটক করে এবং ৯৯৯ নম্বরে ফোন করলে খিলগাঁও থানা পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে আসে। অথচ এজাহারে সংবাদ প্রাপ্তির সময় বিকেল ৪টা ১০ মিনিট উল্লেখ করা হয়েছে, যা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
এ ঘটনায় আদালত খিলগাঁও থানার ওসি ও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জানতে চেয়েছেন, কেন এই সময়গত অসংগতি রয়ে গেল। কবে, কতটায় শিশুদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তা কেন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া আসামিদের ফরোয়ার্ডিং পত্রে (চালানপত্র) উল্লেখ করা হয়েছে, শিশুরা পাবলিক কর্তৃক মারধরের শিকার হয়েছে। অথচ তাদের দেহে নীলাফোলা জখম থাকার পরও চিকিৎসার কোনো রেকর্ড বা চিকিৎসা সনদ আদালতে দাখিল করা হয়নি। শিশুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তা-ও পরিষ্কার নয়। আদালত জানতে চেয়েছেন, শিশুদের কেন চিকিৎসা করা হয়নি বা আদালতে চিকিৎসার রেকর্ড দাখিল করা হয়নি।
আদালত আরও বলেন, কেন প্রকৃত এজাহারভুক্ত শিশুদের গ্রেপ্তার না করে মনগড়া নাম ও বয়স সংযোজিত করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আদালতে মামলার নথির সঙ্গে জব্দ তালিকা দেওয়া হয়নি। এসব বিষয়ে খিলগাঁও থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে আদালত আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেও নোটিশে জানানো হয়।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সাখাওয়াত হোসেন কালবেলা বলেন, ‘আইনে বলা আছে ৯ থেকে ১২ বছরের যে শিশু অপরাধ সম্পর্কে বুঝতে পারে না, তাকে আসামি করা যাবে না। কিন্তু আদালতে পাঠানো আসামি শিশু হলেও পেশাদার চোর। তাদের বোঝার ক্ষমতা আছে। আসামিদের সকাল ৬টা ৫৫ মিনিটে জনতা আটক করলেও আমাদের জানায় সকাল ৯টায়। এরপর মামলার নানা প্রক্রিয়া করতে সময় লাগে। বিকেলে মামলা হয়। এরপর আসামিদের ঠিকানা, পরিচয় জানতে একটু দেরি হয়। মামলা করার সময় আসামিরা এক নাম বললেও পরে যাচাই-বাছাই শেষে ঠিক নাম বের হয়। এজন্য চালানপত্রে ভিন্ন নাম হয়েছে। তাদের চিকিৎসা করা হয়েছে। পরদিন দুপুরে থানা থেকে কোর্টে গেলেও রাস্তায় আন্দোলনের কারণে ৩ ঘণ্টার জ্যাম হয়। এজন্য আদালতে যেতে একটু দেরি হয়েছে। আসলে কপাল খারাপ হলে যা হয়। আমরা ব্যাখ্যা তৈরি করছি। আদালতে দাখিল করব।’
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নারী ও শিশু আদালত-৩ এর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) সাজ্জাদ হোসেন সবুজ বলেন, আইনে বলা আছে, ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। ঘটনাটি আইন পরিপন্থি। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টার ভেতর আসামি আদালতে হাজির করার বিধান রয়েছে। তারা চুরি করলে জব্দ তালিকা নেই কেন। শিশু সুরক্ষার আইন লঙ্ঘন কাম্য নয়।
মন্তব্য করুন