ভারতের আদানি গ্রুপের ঝাড়খন্ড বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দাম নিয়ে বিরোধ রয়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে, যা নিষ্পত্তিতে পিডিবি থেকে একাধিকবার আলোচনায় বসার অনুরোধ জানানো হলেও আদানির তরফ থেকে খুব একটা আগ্রহ দেখানো হয়নি। তবে বাংলাদেশ সরকারের অব্যাহত চাপের মুখে অবশেষে চলতি মাসে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে আদানি গ্রুপ। আগামী ২২ বা ২৩ জুন এই বৈঠক হবে। এতে পিডিবি ও আদানির চারজন করে কর্মকর্তা অংশ নেবেন। পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা আদানির সঙ্গে কয়লার মূল্য নিয়ে আলোচনা করব। এটাই মূল বিষয়। বিদ্যমান বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) ভিত্তিতেই এই আলোচনা হবে।’ উভয়পক্ষের চার সদস্যের প্রতিনিধিদল আলোচনায় অংশ নেবে উল্লেখ করে তিনি জানান, পিডিবির প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন সংস্থাটির সদস্য (কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স) অ. ন. ম. ওবায়দুল্লাহ।
জানা গেছে, পিডিবির সঙ্গে হতে যাওয়া বৈঠকে আদানির পক্ষে যে চারজন অংশ নেবেন, তাদের মধ্যে তিনজন হলেন আইন বিশেষজ্ঞ দ্য আর্বিট্রেশন চেম্বারসের (টিএসি) অধ্যাপক লরেন্স বু ও লুসি রিড এবং সিঙ্গাপুরের ডাক্সটন হিল চেম্বারসের টোবি ল্যান্ডাউ-এর প্রফেসর ভি. কে. রাজা। এই প্যানেলটিতে পিপিএ-এর ধারা ১৯ অনুযায়ী আদানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা যুক্ত হয়েছেন।
এর আগে গত ২৩ মে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন আদানি পাওয়ারের সিইও এসবি খাইলিয়া (SB Khylia)। এ সময় বকেয়া বিল দ্রুত পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বকেয়ার কারণে ব্যাংক ঋণের ফলে ক্রমবর্ধমান চাপ বাড়ছে।’ তার সঙ্গে ছিলেন আদানি পাওয়ারের প্রেসিডেন্ট (কমার্শিয়াল) এম. আর. কৃষ্ণ রাও।
জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, আদানির বকেয়া বিলের পরিমাণ ৪৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে, আদানি দাবি করেছে, বকেয়ার এই পরিমাণ ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। কয়লার দাম নিয়ে দুপক্ষের পৃথক পৃথক হিসাবের কারণে এই পার্থক্য হয়েছে। পিডিবি- সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই পক্ষের আলাদা আলাদা হিসাবে কয়লার দামে টনপ্রতি ১০ থেকে ১২ মার্কিন ডলারের পার্থক্য রয়েছে। কয়লার দামের এই পার্থক্যের কারণে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামও বেশি পড়ছে। মূলত এই বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে বৈঠকে বসতে যাচ্ছে দুপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়লার দাম নির্ধারণে পিডিবি ইন্দোনেশিয়ান কোল ইনডেক্সকে মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করে। বাংলাদেশের সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে এই ইনডেক্স অনুযায়ী কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয়। আর আদানি অস্ট্রেলিয়ান কয়লার দাম বিশেষ করে নিউক্যাসল এবং নিউক্যাসল বেসিন থেকে প্রাপ্ত দাম ধরে কয়লার মূল্য নির্ধারণ করে। এর ফলে কয়লার দাম টনপ্রতি ১০-১২ মার্কিন ডলার বেড়ে যায়।
পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে কয়লা কেনায় ছাড়ের বিষয়টি রয়েছে। পায়রা কেন্দ্র ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা কেনার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে দামে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পায়, যার সুবিধা প্রকৃতপক্ষে পিডিবি ভোগ করে। রামপাল কেন্দ্রও বছরব্যাপী কয়লা কেনার সময় ছাড়ের শর্তেই চুক্তি করে। আদানি নিজের খনির কয়লা সরবরাহ করে। তাদের চুক্তিতে ছাড়ের বিষয়টি নেই। ফলে কয়লার দাম বেশি নিচ্ছে ভারতীয় কোম্পানিটি।
পিডিবির ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, অন্যসব বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লার কেনা দাম ধরেই বিল করে। তবে চুক্তি অনুযায়ী আদানি কয়লার দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার সূচকের গড় মূল্য হিসাব করে। আন্তর্জাতিক দুই সূচকে বিভিন্ন মানের কয়লার দাম প্রকাশ করা হয়। দুই সূচকে উন্নতমানের কয়লার দামের গড় হিসাব বের করে প্রতিষ্ঠানটি। তা থেকে তারা যে মানের কয়লা ব্যবহার করে, তার দাম নির্ধারণ করে।
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতীয় কোম্পানি আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে তখনই ব্যাপক সমালোচনা হয়। অভিযোগ ওঠে প্রতিষ্ঠানটিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চুক্তিটি বাতিলের দাবি ওঠে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি আদানির সঙ্গে চুক্তি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই স্বাক্ষরিত আরও সাতটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করছে। পর্যালোচনা কমিটি আদানির সঙ্গে চুক্তি আন্তর্জাতিক চুক্তি হওয়ার কারণে পিডিবিকে সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক সালিশ কেন্দ্রের (এসআইএসি) মাধ্যমে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে।
২০১৭ সালে বিদ্যুৎ বিভাগ ও আদানি পাওয়ারের মধ্যে একটি ক্রয় চুক্তি হয়। চুক্তির আওতায় আদানি ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলায় ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে। একই বছর আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে পিডিবি। চুক্তি অনুযায়ী, এই কেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কেনা হবে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আমদানির তথ্যানুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৬টায় ৬৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়েছে আদানির এই কেন্দ্র থেকে।
মন্তব্য করুন