ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে রংপুরের গঙ্গাচড়ার আলদাদপুর গ্রামে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসতবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার নেতৃত্ব দেয় স্থানীয় কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক। সেদিন তারা কারও কোনো কথা শোনেনি। স্থানীয়দের ভাষ্য—যেসব যুবক হামলার উসকানি দিয়েছে, তারা থাই লটারি ও ভিসা প্রতারণার সঙ্গে জড়িত।
মাগুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান মিঠু বলেন, ‘আমি মাইকে সবাইকে বলেছি—যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তাই উত্তেজীত হওয়ার কিছু নেই। মানববন্ধন চাইলে এই এলাকায় করুন। কিন্তু সেখান থেকে কয়েক উচ্ছৃঙ্খল যুবক আমাকে গালাগাল করে এবং আমার অনুরোধ অমান্য করে লাঠি হাতে আলদাদপুরের দিকে রওনা দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি পরিস্থিতি ঠেকাতে বারবার চেষ্টা করেছি, এমনকি খিলালগঞ্জ বাজারের পাশে ব্যারিকেড দিলেও ওই যুবকরা কারও কথা না শুনে ব্যারিকেড ভেঙে গ্রামের দিকে এগিয়ে যায়।
গ্রামের বাসিন্দা অতুল চন্দ্র রায় বলেন, ‘সকালে (২৭ জুলাই) কয়েকজন এসে বলল—কাকা এখানে সমাবেশ হবে, আপনারা সহযোগিতা করবেন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনারাও তো চান, যিনি দোষ করেছেন, তার শাস্তি হোক। কিন্তু সকালে সহযোগিতা চেয়ে বিকেলে এসে আমাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করল।’
চন্দনা রানী বলেন, ‘যখন ওরা লাঠিসোটা নিয়ে আইসে, তখন হামরা বাড়ি থাকি পালাইছি। বিয়্যানা (সকালে) সহযোগিতা করবের কথা কয়া হঠাৎ আসি হামলা করিল।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য রুহুল আমিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার দিন বিকেলে তিনি একটি ভ্যানে করে গঙ্গাচড়া-কিশোরগঞ্জ সীমান্তবর্তী খিলালগঞ্জ বাজারের সেতুর কাছে যান। সেখানে সেতুর এক পাড়ে ইজীবাইক দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া ছিল। তিনি সেখানে কয়েকজন হুজুরকে সঙ্গে নিয়ে সবাইকে শান্ত করতে বলেন এবং লাঠি ফেলে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু মিছিলকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে সামনে এগিয়ে যায়।
আলদাদপুর গ্রামের বাসিন্দা প্রশান্ত কুমার রায় বলেন, ‘বিক্ষোভকারীরা সেতু পার হয়ে খিলালগঞ্জ বাজারে পৌঁছলে গঙ্গাচড়া থানার পুলিশ তাদের বাধা দেয়। কিন্তু তারা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ও হামলা চালায়। এরপর বিক্ষোভকারীরা মিছিল নিয়ে গ্রামমুখী হলে হিন্দুপাড়ায় প্রবেশের দুটি পথেই পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু সেখানেও তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ সদস্যরা আহত হলে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে আশ্রয় নেন।’
প্রশান্ত কুমার রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, এরপর ঘণ্টাব্যাপী হামলাকারীরা গ্রামের অন্তত ১৫টি হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। হামলাকারীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করার কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনী সেখানে পৌঁছায়
পুলিশের ব্যর্থতাকে দায়ী করছে এলাকাবাসী: হামলার ঘটনার জন্য কিশোরগঞ্জ থানা পুলিশের দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তাদের অভিযোগ, ঘটনার দিন সকাল থেকেই সিঙ্গেরগাড়ী বাংলাবাজার এলাকায় মাইকিং করে বিক্ষোভকারীরা মানববন্ধনের নামে জমায়েত শুরু করলেও পুলিশ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে থাকলেও সেখানে পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি।
যদিও কিশোরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল ইসলামের দাবি, বাংলাবাজার এলাকায় কোনো বিক্ষোভ হয়নি। তবে পুলিশ সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছিল। ঘটনাস্থলে ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিল। তবে সেখানে উপস্থিত মাগুরা ইউপি চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান মিঠু বলেন, তিনি ঘটনাস্থলে ৩-৪ জন পুলিশ সদস্যকে দেখতে পান। পরে তিনি বিক্ষোভকারীদের নিবৃত্ত করতে পুলিশ সদস্যদের ডাকলেও তাদের সহযোগিতা পাননি।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত মাগুরা ইউনিয়নের ৮নং ইউপি সদস্য রুহুল আমিন বলেন, ওই দিন পুলিশ কোনো ভূমিকা পালন করেনি। পুলিশ চাইলে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করতে পারত, সেনাবাহিনীকে ডাকতে পারত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকলে এই হামলা ঠেকানো যেত।
এসব বিষয়ে জানতে দুই দিন ধরে নীলফামারী জেলা পুলিশ সুপারকে তার মোবাইল ফোনে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সাংবাদিকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ—ওসিকে প্রত্যাহার ও তদন্ত দাবি: তথ্য সংগ্রহে গিয়ে কিশোরগঞ্জ থানায় গালাগাল ও আটকের হুমকির শিকার হয়েছেন দুই সাংবাদিক। আলদাদপুরে হামলার আগে কিশোরগঞ্জের বাংলাবাজারে মানববন্ধন ঘিরে পুলিশের প্রস্তুতি কেমন ছিল—এমন প্রশ্ন করায় ওসি মো. আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলো ও কালবেলার দুই প্রতিবেদককে অকথ্য ভাষায় গালি দেন এবং উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের তাদের আটক করতে বলেন।
এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ওসির অপসারণ ও বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন-আরপিইউজে, রংপুর রিপোর্টার্স ক্লাব, নীলফামারী সাংবাদিক ইউনিয়ন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, রংপুর অনলাইন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন।
আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ওসি আশরাফুল ইসলামকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত ও বিভাগীয় ব্যবস্থা না নেওয়া হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন সাংবাদিক নেতারা।
মন্তব্য করুন