বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২৫, ০৮:১১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে বাধা দুদক ও সিআইডির মামলা

জনশক্তি রপ্তানি
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে বাধা দুদক ও সিআইডির মামলা

মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ও সিআইডিতে তদন্তাধীন থাকা অর্থ পাচারের মামলাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ২৩ এপ্রিল মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে ‘অপ্রমাণিত অভিযোগ’ ও ‘হয়রানিমূলক’ উল্লেখ করে মামলা ও অনুসন্ধানগুলো প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন। পরে সরকারের পক্ষে মামলা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মালয়েশিয়া সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওসব চিঠির আলোকে এরই মধ্যে পল্টন থানায় ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেনের করা মানব পাচারের মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে সিআইডি। আদালত এরই মধ্যে সেটা গ্রহণ করেছে। কিন্তু পল্টন থানায় থাকা মামলার অন্য অংশটি (অর্থ পাচার) তদন্তাধীন। এ ছাড়া সরকারি সংস্থা হিসেবে দুদক বেশ কয়েকটি মামলা করেছে এবং কিছু অনুসন্ধান চলমান। সেগুলো এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার হয়নি।

জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আগামী ১১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মালয়েশিয়া সফরের আগে তদন্তাধীন মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা প্রত্যাহার হলে এবং অনুসন্ধানে থাকা অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি করা গেলে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এসব মামলার কারণে এরই মধ্যে মালয়েশিয়ার মানব পাচার সূচক (টিআইপি) তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, গত ২৬ এপ্রিল মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ায় ২০২২-২৪ পর্যন্ত শ্রমিক নিয়োগ সম্পর্কিত উত্থাপিত অভিযোগগুলো তারা পর্যালোচনা করেছে। সেখানকার ফরেন ওয়ার্কার সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকে (এফডব্লিউসিএমএস) একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং ডিজিটালাইজড নিয়োগ কাঠামো হিসেবে বলেছে। তারা চিঠিতে আরও বলেছে, ‘সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় কর্মীদের অভিবাসন সম্পর্কিত সব বিচারাধীন মামলা ও অভিযোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা হয়েছে। মামলাগুলো হয়রানিমূলক ও অপ্রমাণিত হওয়ায় সেগুলো প্রত্যাহার করা, অনুসন্ধান বা তদন্ত থেকে বাদ দেওয়ার উপায় খোঁজার অনুরোধ করে।

মালয়েশিয়া চিঠিতে আরও বলেছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলার রেকর্ড হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সহায়ক প্রমাণ সরবরাহ করা হয়নি। তা ছাড়া এর আগে খারিজ হওয়া মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত বন্ধের বিষয়ে তারা তাগিদ দেয়।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। এটা মূলত উভয় সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত আনুষ্ঠানিক নিয়োগ চ্যানেলের মাধ্যমে হয়েছে। এসব শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে মানব পাচারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। চিঠিতে মালয়েশিয়া সরকার স্বচ্ছ ও নীতিগত নিয়োগ অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের টিআইপি (মানব পাচার র্যাঙ্কিং) বজায় রাখা এবং উন্নত করার জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা চেয়েছে।’

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়ার চিঠির পর গত মে মাসে ঢাকায় যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়। ওই সভায় দুপক্ষই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। পরে গত আগস্ট মাসে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্লাহ মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় করে চিঠির জবাব দেন। ওই চিঠিতে কী উল্লেখ করা হয়েছে, জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে উত্থাপিত ‘মানব পাচার’ এবং অর্থ পাচারের অভিযোগগুলো মূলত অপ্রমাণিত। এসব অভিযোগ মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। ওই সময়ের মধ্যে উভয় সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি কর্মীকে দুদেশের সম্মতিতে নিয়োগ করা হয়েছে। গত মে মাসের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সভায় সব বিচারাধীন অভিযোগ বা মামলা পর্যালোচনা করা এবং মালয়েশিয়ায় কর্মী সরবরাহের ‘অপ্রমাণিত অভিযোগ’ প্রত্যাহার করাসহ পারস্পরিক আস্থা পুনরুদ্ধার করার কথা বলা হয়। বাংলাদেশ সরকার মনে করে এসব মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে মানব পাচার র্যাঙ্কিং (টিআইপি) সংরক্ষণ এবং উন্নত করা সম্ভব হবে।’

জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা জানান, মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়ার পর এরই মধ্যে সিআইডিতে তদন্তাধীন থাকা রাজধানীর পল্টন থানায় করা মানব পাচারের মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু অর্থ পাচারের অভিযোগটি সিআইডিতে তদন্তাধীন। এ ছাড়া বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত শ্রমিক নিয়োগে কাজ করা কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মালয়েশিয়া সরকার মামলাগুলো ‘অপ্রমাণিত’ ও ‘হয়রানিমূলক’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তাই প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার সফরে যাওয়ার আগে মামলাগুলো প্রত্যাহার হওয়া জরুরি। এর আগে ১০ রিক্রুটিং লাইসেন্স যখন মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠিয়েছিল তখনো দুদক মামলা করেছিল। কিন্তু সেগুলো পরে প্রমাণিত না হওয়ায় ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে।’

জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, মূলত ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকে ব্যবসায়ীদের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে করা মামলা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। অথচ কোনো ভুক্তভোগী বা পাচারের শিকার কোনো শ্রমিক মামলা করছে না। দুদেশের সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে শ্রমিক পাঠানো হয়েছে। সেখানে মানব পাচার বা অর্থ পাচারের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এর আগে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা মালয়েশিয়া সরকারকে সব ধরনের অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্ত প্রত্যাহার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই প্রতিশ্রুতির চার মাস পেরিয়ে গেলেও মামলাগুলো প্রত্যাহার হয়নি। এখন প্রধান উপদেষ্টার সফরের সময় যদি মামলাগুলো প্রত্যাহার বা ফাইনাল রিপোর্ট সংক্রান্ত নথি মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করা যায়; তাহলে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। দ্রুতই বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য উন্মুক্ত হবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।

মামলা প্রত্যাহার বা মালয়েশিয়ার চিঠির বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নেয়ামত উল্ল্যা ভূঁইয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী কালবেলাকে বলেন, ‘আমার কাছে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো প্রস্তাব বা সুপারিশ আসেনি। আমার মনে হয়, বিষয়টি এখনো সচিব বা ডিজি পর্যায়ে আছে।’

মালয়েশিয়ার বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে অনেক বড় ও রেমিট্যান্স আরোহণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বায়রার মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কোন রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসা করল, কোন এজেন্সি করল না— সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে, কম অভিবাসন ব্যয় বা শূন্য অভিবাসন ব্যয়ে আমাদের শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মসংস্থান। আমরা চাই আমাদের শ্রমিকরা ভালো থাকুক, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিপাক।’ আর সে জন্য মামলা প্রত্যাহারসহ সরকারের যা করণীয় সব করার উচিত বলে মনে করেন রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠনের এ নেতা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

 গাজায় দুর্ভিক্ষ হচ্ছে কি না, জানালেন জাতিসংঘ মহাসচিব

কেন্দ্র দখল করলেই ভোট বাতিল : সিইসি

গোপালগঞ্জে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আ.লীগের ৬ নেতার পদত্যাগ

সিপিএলে সাকিবের ব্যর্থতা চলছেই, দল হারল ৮৩ রানে

কটাক্ষের শিকার আলিয়া

ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের বেন গুরিয়নের ফ্লাইট স্থগিত

ওজন কমাতে চা

‘কাউকে দোষারোপ করছি না’, বিভুরঞ্জনকে নিয়ে ছেলে ও ভাই

আজ ঢাকার বাতাসে দূষণের পরিমাণ কত?

রাজধানীতে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত

১০

সেরা অধিনায়ক কে? অপ্রত্যাশিত নাম বলে চমকে দিলেন দ্রাবিড়

১১

মাইলস্টোনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু

১২

শাহরুখের ওপর বিরক্ত বোমান ইরানি

১৩

জেনে নিন আজকের স্বর্ণের বাজারদর

১৪

প্রীতি ম্যাচ খেলতে কবে ভারত আসছে মেসির আর্জেন্টিনা জানাল এএফএ

১৫

নতুন করে মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছে ইরান

১৬

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

১৭

বাংলাদেশের ম্যাচসহ টিভিতে আজকের খেলা

১৮

গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ, একই পরিবারে দগ্ধ ৯

১৯

২৩ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

২০
X