আন্তর্জাতিক মান অর্জনে ইউনিভার্সাল টিকেটিং সিস্টেম (ইউটিএস) বা সর্বজনীন টিকিট পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। আর টিকিট ব্যবস্থাপনার নতুন এই পদ্ধতি প্রচলনে ঠিকাদার নিয়োগের উদ্যোগ নেয় মেট্রোরেল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। যদিও শুরুতেই এই ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই দরপত্র প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় সময় বাড়াচ্ছে, এমন অভিযোগও উঠেছে। এমনকি নির্ধারিত সময়ের পরও দরপত্র জমা নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, যেসব প্রতিষ্ঠান দরপত্রের সঙ্গে জামানত জমা দেয়নি, তাদেরও পরে নিয়ম ভেঙে জামানত জমার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। আবার অংশীদারত্ব রয়েছে—এমন দুই প্রতিষ্ঠান একই কাজের জন্য দরপত্রে অংশ নিয়েছে। এতেও আপত্তি জানায়নি ডিএমটিসিএল।
গ্রাহকসেবার মান বৃদ্ধিতে ইউটিএস বা সর্বজনীন টিকিট পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত নেয় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। এই পদ্ধতিতে ব্যাংকের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার (পাঞ্চ) করেও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের ভাড়া পরিশোধ করা যাবে। এ ছাড়া একক যাত্রায় থাকবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাড়া দেওয়ার সুযোগ। বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) তথ্য বলছে, ইউটিএস টিকিট পদ্ধতি পরিচালনায় ঠিকাদার নিয়োগের জন্য গত ২৮ মে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৩০ জুন বিকেল ৩টায় ছিল দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময়। আর এর আধাঘণ্টা পর দরপত্র বাক্স খোলার কথা ছিল। পরে সেই সময় বাড়িয়ে ২১ জুলাই করা হয়।
মোট আটটি প্রতিষ্ঠান এই দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। তবে এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রের শর্তে উল্লেখ করা জামানত বা বিল বন্ড জমা দেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, পরবর্তী মূল্যায়নে জামানত না দেওয়া ওই দুই প্রতিষ্ঠানের দর প্রস্তাব বিবেচনার কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়। দরপত্রে অংশ নেওয়া বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠানের দর প্রস্তাব ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মানদণ্ড পর্যালোচনা করে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার কথা। কিন্তু এই দরপত্রে অংশ নেওয়া একাধিক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময়ের পরও আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। আর নিয়ম ভেঙে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ সেসব দরপত্র গ্রহণও করে। এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আবার একটি প্রতিষ্ঠান কোনো বিল বন্ড ছাড়াই দরপত্র জমা দেয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায়) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘বিশেষ কাউকে সুবিধা দিতে সময় বাড়ানো হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আর পর্যাপ্ত ডকুমেন্ট না পেয়েও কোনো প্রতিষ্ঠানকে তালিকায় রেখে শর্টলিস্ট করেছে—এমন তথ্য আমার জানা নেই। তবে শুনেছি, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে সময় বাড়ানো হয়েছে এবং এই সময় বাড়ানোর সুবিধা অংশগ্রহণকারী অন্য সব প্রতিষ্ঠান পাবে। এই মুহূর্তে টেন্ডার ইভোলিউশন (দরপত্র মূল্যায়ন) পর্যায়ে রয়েছে। চলতি সপ্তাহে ইভোলিউশন শেষ হবে।’
এদিকে একই প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন নামে দরপত্রে অংশ নিয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, এডিএন টেলিকম লিমিটেড এবং সহজ লিমিটেড পারস্পরিক ব্যবসায়িক অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও এই দরপত্রে এডিএন টেলিকম লিমিটেড নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এবং সহজ লিমিটেড নির্দিষ্ট সময়ের পর দরপত্র জমা দেয়। ২০২৩ সালের জুনে ১২ কোটি টাকায় সহজের ১০ শতাংশ শেয়ার কেনে এডিএন। পিপিআর-২০০৮ এবং দরপত্রের ধারা অনুযায়ী, এ দুই প্রতিষ্ঠানকে এ ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণার বিধান রয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সহজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মালিহা কাদিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে সহজের পক্ষে চিফ কমিউনিকেশন অফিসার কর্নেল (অব.) আমীন কালবেলার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় আর্থিক যাচাই-বাছাইয়ের সময় সহজ লিমিটেডকে দরপত্রে কাজ পাওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল (অব.) আমীন বলেন, ‘এডিএনের সঙ্গে সহজের পার্টনারশিপ (অংশীদারত্ব) হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই প্রতিষ্ঠানই দরপত্রে অংশ নিতে পারে কি না, সে আলোচনা তুলে আর কী হবে? সহজ তো বাদ হয়েই গেছে।’
দরপত্র প্রক্রিয়ার বিভিন্ন অসংগতির বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয় ডিএমটিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (স্টোর ও প্রকিউরমেন্ট) শাব্বীর আহমদের কাছে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে ইভোলিউশন পর্যায়ে রয়েছে। কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে ইভোলিউশন কতদিন চলবে। যাচাই প্রক্রিয়ায় আমি আপনার (এই প্রতিবেদক) কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না।’
মেট্রোরেলে যাত্রীদের যাতায়াত আরও সহজ করতে ইউটিএস চালু করতে ঠিকাদারদের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বর্তমানে চালু থাকা র্যাপিড ও এমআরটি পাস এবং একক যাত্রার কার্ডও কার্যকর থাকবে। নতুন ব্যবস্থায় ভাড়া আদায়ের জন্য মেট্রোরেল স্টেশনগুলোতে নতুন কিছু যন্ত্র বসানো হবে। সেগুলোতে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করে ভাড়া পরিশোধ করা যাবে।
ডিএমটিসিএলের এক কর্মকর্তা জানান, ব্যবস্থাটি চালু করতে সরকার কোনো বিনিয়োগ করবে না। যন্ত্রপাতি স্থাপন, সফটওয়্যার ইনস্টলেশন ও লেনদেন সম্পন্নের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। টিকিট বিক্রির টাকা থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ সেই ঠিকাদারকে দেওয়া হবে। তবে তা কত হবে, এখনো ঠিক হয়নি। ঠিকাদারদের কাছ থেকে পাওয়া দর প্রস্তাবের ওপর এটি নির্ভর করবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘সারা পৃথিবী এগিয়ে গেছে, আর আমরা এখনো ৬০ বছরের পুরোনো টিকেটিং ব্যবস্থায় আটকে আছি। আধুনিক টিকেটিং ব্যবস্থা শুরুতেই চালু হওয়া দরকার ছিল। যত দ্রুত চালু হবে, তত দ্রুত যাত্রীরা উপকৃত হবে।’
মন্তব্য করুন