দিন যত যাচ্ছে, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল ততই দীর্ঘ হচ্ছে। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু। দেশে এরই মধ্যে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু ও শনাক্তে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিধনে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। মশা নিধনে কোনো পদ্ধতিই কাজে আসছে না। উল্টো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা যাচ্ছে এ খাতে।
গত তিন মাসে মশক নিধন অভিযানে এডিসের লার্ভা পাওয়ায় নগরবাসীর কাছ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। নগরের বাসিন্দারা বলছেন, সিটি করপোরেশনগুলো তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করছে না। জরিমানা করে ব্যর্থতার দায় চাপাচ্ছে নগরবাসীর ওপর। যদিও ব্যর্থতার দায় নিতে নারাজ সিটি করপোরেশন। বলছে, তাদের কাজে কোনো গাফিলতি নেই।
কীটতত্ত্ববিদদের মতে, সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে ব্যর্থ হচ্ছে দুই সিটির নানা উদ্যোগ। আগে থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দুই সিটি করপোরেশনের মশক বিভাগকে ঢেলে সাজানো দরকার। বছরের শুরুতে বিশেষ পরিকল্পনা, অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ, নিয়মিত মশার ঘনত্ব জরিপ, মশক কার্যক্রম তদারকি ও মূল্যায়ন এবং কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষার নিয়মিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শুধু অর্থ জরিমানা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) গত ১৮ জুন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করে। গত শনিবার পর্যন্ত ২০ হাজার ৪০৪টি বাসাবাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন ও স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়। এ সময় ৬৯৪ বাসাবাড়ি, স্থাপনা ও নির্মাণাধীন ভবনে মশার লার্ভা পাওয়া যায়। ৬১৮টি বাসাবাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন ও স্থাপনা থেকে ৭৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
ডিএসসিসি জানিয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু রোগীর তালিকায় দক্ষিণ সিটির বাসিন্দা ৮ হাজার ৬০৪ জন, যা শতকরা ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। মশা নিয়ন্ত্রণে সংস্থাটির বার্ষিক কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে মতবিনিময় সভা, মশককর্মীদের প্রশিক্ষণ, জনসম্পৃক্তকরণ, মাইকিং, কীটনাশক প্রয়োগ, চিরুনি অভিযান, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা। এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগীর বাড়িতে বিশেষ অভিযান, লাল চিহ্নিত ওয়ার্ডে বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চিরুনি অভিযান, নিজস্ব ও অন্যান্য স্থাপনায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং মশক নিধনে চিরুনি অভিযান, ছাদ বাগানের পরিচর্যা এবং কীটনাশক ও যন্ত্রপাতির মজুত করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) গত ৮ জুলাই থেকে এডিস মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ মশক নিধন কর্মসূচি শুরু করে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত ৬ লাখ ১২ হাজার ৭২টি সড়ক, ড্রেন ও স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৭৬টিতে লার্ভা পাওয়া গেছে। নিয়মিত মামলার সংখ্যা ১০২টি। ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা হয়েছে ৩৭৬টি। ৪ হাজার ৭৩টি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে ৪ লাখ ১৪ হাজার সড়ক, ড্রেন ও স্থাপনায় লার্ভিসাইডিং করা হয়েছে। নোভালুরণ প্রয়োগ করা হয়েছে ৯২ হাজার ৮২১টিতে। পানির চৌবাচ্চা, দইয়ের হাঁড়ি, চিপসের প্যাকেট ও নির্মাণাধীন বাড়ির ভেতরে সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে।
মশা মারতে চলতি অর্থবছরে ১৬৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাজেট রয়েছে দুই সিটি করপোরেশনের। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ও উত্তর সিটি বরাদ্দ করেছে ১২১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
পুরান ঢাকার এক বাসিন্দা বলেন, সিটি করপোরেশন বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা খুঁড়ে রেখেছে। সেখানেও পানি জমে থাকে। এ থেকেও ডেঙ্গু ঝুঁকি বাড়ছে। সিটি করপোরেশনের এ ধরনের কাজের দায় কার? খুঁড়ে রাখা রাস্তায় জমে থাকা পানিতে মশা বংশবিস্তার করলে কাকে জরিমানা করা হবে?
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান কালবেলাকে বলেন, দেশের ইতিহাসে মশক নিধনে কেউ সফল হয়েছেন বলে জানা নেই। এ নিয়ে প্রায় সব এলাকার নাগরিকই মেয়রের ওপর অসন্তুষ্ট। কিছুদিন আগে মশা নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ড্রোনের মাধ্যমে বাড়ির ছাদে মশার লার্ভা আছে কি না, যাচাই শুরু করে ডিএনসিসি। মশক নিধনকর্মীরা যাতে ফাঁকি দিতে না পারে, সেজন্য বায়োমেট্রিক হাজিরার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু কোনো উদ্যোগেই মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, মশা নিধনের মূল দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। কোনোভাবেই তারা এই দায় এড়াতে পারে না। বরং সাধারণ নাগরিকের ঘরে ঘরে গিয়ে জরিমানা করার মাধ্যমে নিজেদের দায় জনগণের ওপর চাপানোর চেষ্টা চলছে। আমাদের নিজেদেরও সচেতনতার ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে হোল্ডিংয়ের জন্য আমাদের অর্থ দিতে হয়। যাকে আমি সার্ভিসের জন্য টাকা দিচ্ছি, তার কাছ থেকে সার্ভিস না পেলে নিশ্চই কথা বলার সুযোগ থাকে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তথা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মশা নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ। সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, তারা এ ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন। তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষ কিংবা আক্রান্তের পরিবারের কষ্ট বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের পুরোপুরি সুস্থ হতে অন্তত ১৫ দিন লাগে। এরপর আরও ১৫ দিন লাগে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে। সাধারণত ঢাকা শহরে দরিদ্র পরিবারের মানুষই বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে। একটা পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি যখন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, তখন সে পরিবারটির অন্তত এক মাস উপার্জন থাকে না। তাদের দিন কাটে ভয়াবহ কষ্টে ও দুঃসহ যন্ত্রণায়। এ সময়টায় শুধু ঢাকা নয়, দেশের সব দরিদ্র পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আর্থিক সহায়তা করা উচিত।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশক নিধনের জোর চেষ্টা চলছে। নিয়মিত ওষুধ ছিটানো ছাড়াও আমরা যেখানেই লার্ভা পাচ্ছি, সেখানেই অভিযান চালাচ্ছি। মানুষকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতন করা হচ্ছে। স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে কার্টুন বই বিতরণ করা হয়েছে। প্রতি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পৃথক কমিটি করা হয়েছে। মানুষ সচেতন হলে আমরা ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পাব।
মশক নিধনে ব্যর্থতা আছে কি না, জানতে চাইলে ডিএসসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, যারা এ অভিযোগগুলো করছেন, তারা না জেনে, না দেখে এবং না বুঝে করছেন। সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। যদি সিটি করপোরেশনের গাফিলতি থাকত, তাহলে রোগী এত কমে আসত না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় বলা হচ্ছে, ঢাকার রোগী কমছে এবং অন্য এলাকার রোগী বাড়ছে। এখনো যে রোগীর সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেখাচ্ছে এর বেশিরভাগই ঢাকার বাইরের রোগী। তারা ঢাকায় চিকিৎসা করাতে এসেছে। ঢাকা দক্ষিণে রোগী অনেক কমে এসেছে। মশক নিধন কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। নারী-পুরুষ মিলিয়ে ১০০ কাউন্সিলর সকাল-বিকেল দুবেলা মশক নিধন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন। মেয়র নিজে মাঠপর্যায়ে যাচ্ছেন। আমাদের সংসদ সদস্যরা বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে আমরা কাজ করছি। আমাদের কার্যক্রমে অতি দ্রুত ঢাকায় রোগীর সংখ্যা আরও কমবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা যেসব কীটনাশক ব্যবহার করছি, তা শতভাগ কার্যকরী। মশার ওষুধ ক্রয় করা হয় টেকনিক্যাল কমিটির প্রস্তাবে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে। কেনার পর ফিল্ড টেস্ট করা হয়। এতে ফল ৯৮-৯৯ শতাংশ কার্যকরী হলে তবেই ওষুধটি আইইডিসিআর ও পিপিডব্লিউর ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। পজিটিভ রেজাল্ট আসার পর আমরা সেটি ব্যবহার করি।
মন্তব্য করুন