

দীর্ঘদিন ধরে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্সে (ভ্যাট) ফাঁকি বন্ধে অডিট ও প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বড় অঙ্কের ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায় করে বিভিন্ন ভ্যাট কমিশনারেট। কিন্তু ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটনের এমন প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ রেখে বছরের মাঝামাঝি ভ্যাটে বাড়তি ২০ হাজার কোটি টাকার নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এনবিআর। এ ছাড়া এই বাড়তি ভ্যাট আদায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই বলেও জানিয়েছেন খোদ এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান। তবে চলতি মাসের মধ্যে নতুন ১ লাখ প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। বছরের পর বছর ধরে চলা ভ্যাট ডিজিটালাইজের স্লোগান সামনে রেখে আজ সারা দেশে ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ পালন করবে সংস্থাটি। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। বছরের মাঝামাঝি এসে এনবিআর আরও ৫৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৫ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। নতুন করে আরও ২০ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা বাড়িয়ে করা হয় ২ লাখ ৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। ভ্যাট ফাঁকি প্রতিরোধে সাধারণত এনবিআরের বিভিন্ন ভ্যাট কমিশনারেট অডিট এবং প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। তবে বর্তমান সময়ে ভ্যাট কমিশনারেটগুলোর অডিট এবং প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে। নতুন করে আগের মতো আর রেন্ডম অডিট বা প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম অলিখিতভাবে বন্ধ রয়েছে। কয়েক বছর ধরে অডিট কার্যক্রম চলছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের হাতেগোনা কয়েকটা অডিট হচ্ছে। যার কারণে ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন কার্যক্রম প্রায় বন্ধই বলা চলে বলেও জানিয়েছেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ভ্যাটের নতুন লক্ষ্যমাত্রা দিলেও বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। রাজস্ব বাড়াতে হবে, তাই ভ্যাটের নতুন লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাধারণত এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্থমন্ত্রণালয় নির্ধারণ করলেও এবার নতুন লক্ষ্যমাত্রা এনবিআর কর্তৃপক্ষই নির্ধারণ করেছে। সংস্থাটির সর্বশেষ হিসাবে গত জুলাই-অক্টোবরে ভ্যাট আদায়েও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। এই খাতের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। ভ্যাট আদায় হয়েছে ৪৬ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। এ সময়ে ভ্যাটে ঘাটতি ১ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং অক্টোবরে ৩ লাখ ৪৪ হাজার প্রতিষ্ঠান ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করেছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে চলতি মাসের মধ্যে আরও নতুন করে ১ লাখ প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর আগে কি কোনো ধরনের পরিকল্পনা বা পর্যবেক্ষণ নেওয়া হয়েছে কি না—এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল মঙ্গলবার ভ্যাট দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্যই লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। তবে কোনো অবস্থায় যেন হয়রানি বা জুলুম করা না হয়, সেটা আমরা নিশ্চিত করব। মূলত যারা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন, তাদের কাছ থেকেই আমরা রাজস্ব আদায়ের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে লক্ষ্যমাত্রা সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং, তাই নতুন করে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ভ্যাট আদায় কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতার কারণে চলতি বছর কর আহরণ ব্যাহত হয়েছে। এর ফলে করপোরেট কর আদায় দুর্বল হয়েছে। পাশাপাশি উন্নয়ন বাজেট কমে যাওয়ায় প্রত্যাশার তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহ কম হয়েছে। এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে কর আদায় ১৬ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, ভ্যাট আইন সংশোধনের কাজ চলছে, যাতে প্রক্রিয়া সহজ করা যায় এবং চলমান স্বয়ংক্রিয়করণ কার্যক্রমকে আরও এগিয়ে নেওয়া যায়।
জানা গেছে, এনবিআর প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর ভ্যাট দিবস পালন করে আসছে। প্রতি বছর সেরা ভ্যাটদাতাদের সম্মাননা দেওয়া হলেও গত বছর এবং চলতি বছর ভ্যাটদাতাদের সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে না। সম্মাননা ছাড়াই প্রতি বছরের মতো চলতি বছরও এনবিআর ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ভ্যাট সপ্তাহ উদযাপন করবে। ভ্যাট নিবন্ধনকে গুরুত্ব দিয়ে এ বছরের ভ্যাট দিবসের প্রতিপাদ্য রাখা হয়েছে সময়মতো নিবন্ধন নিব, সঠিকভাবে ভ্যাট দিব। এ ছাড়া আজ বুধবার থেকে মাসজুড়েই দেশব্যাপী নিবন্ধন প্রচার চালাবে এনবিআর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ভ্যাট কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, সাধারণত ভ্যাটের মূল চাপ আসে ভোক্তার ওপর। কোম্পানি বা পণ্য যে কোনো কিছুর ওপর বাড়তি ভ্যাট যোগ হলে তা ভোক্তার ওপরই আসবে। আর নতুন করে ২০ হাজার কোটি টাকা ভ্যাটের বাড়তি চাপ ভোক্তার ওপর পড়বে বলেও জানান তারা।
মন্তব্য করুন