জুনায়েদ শিশির
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ০২:৪৭ এএম
আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:২৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সরকারের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলছেন ব্যবসায়ীরা

দাম বেঁধে দিলেও প্রভাব নেই বাজারে
পুরোনো ছবি
পুরোনো ছবি

এক মাস আগে খুচরা পর্যায়ে তিনটি পণ্যের বাজারমূল্য বেঁধে দিয়েছিল সরকার। সে অনুযায়ী প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬৫, আলু ৩৬ এবং প্রতি পিস ডিম ১২ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। তবে ওই ঘোষণার পর এক দিনের জন্য নির্ধারিত দামে এসব পণ্য কিনতে পারেননি ক্রেতারা। উল্টো গত কয়েকদিনে দাম বেড়েছে আরেক দফা। বাজারে প্রতি হালি ডিমের দাম ৫ টাকা বেড়ে ৫৫, দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর অনেকদিন ধরেই আলুর দাম প্রতি কেজি ৫০ টাকা।

যদিও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নিয়মিতভবে বাজার তদারকি ও আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বেশি দামে পণ্য বিক্রির দায়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে আদায় করা হচ্ছে জরিমানা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তবে বাজারে এসব পদক্ষেপের স্থায়ী কোনো প্রভাব পড়ছে না। সব মিলিয়ে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীরাদের এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে বলে মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকরা।

দাম বেঁধে দেওয়া পণ্যের যখন এই অবস্থা, তখন অন্যান্য ক্ষেত্রে তো ভিন্নচিত্র আশাই করা যায় না। কাঁচাবাজারে বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দল, পটোল, কচুর লতি, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চিচিংগার সরবরাহ পর্যাপ্ত। তবে দামের বেলায় বেশি টাকা দিয়েই কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। চলমান পরিস্থিতিতে সব মহলের সমন্বয় ও সহনশীলতা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

এদিকে গতকাল এক মতবিনিময় সভা থেকে সিন্ডিকেট বা কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। সভায় ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সব কিছুর আগে দালাল ও চাঁদাবাজি বন্ধের পাশাপাশি পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখার তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

ঢাকায় ডিমের পাইকারি ও খুচরা বাজার সূত্রে জানা গেছে, গতকাল প্রতি ১০০ পিস বাদামি ডিম বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২১০ এবং প্রতি ১০০ পিস সাদা ডিম বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১৪০ টাকা, যা পরিবহন খরচ যোগ হয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে দাম পড়েছে ১ হাজার ২৩০ এবং ১ হাজার ১৬০ টাকা। খুচরা পর্যায়ে প্রতি হালি বিক্রি হয়েছে ৫৫ এবং প্রতি ডজন ১৬০ টাকায়। সাদা ডিমের হালি ৫০ টাকা। ডিমের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে সরকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিলেও এখন পর্যন্ত সেসব ডিম আসেনি।

ডিমের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তেজগাঁওয়ের ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উল্লাহ কালবেলাকে বলেন, ‘গত সপ্তাহে টানা বৃষ্টিতে ক্ষতির কারণে বাজারে শাকসবজির দাম বেড়েছে। এতে ডিমের চাহিদা বাড়ায় দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে।’

এদিকে দেশি পেঁয়াজের ঘাটতি মেটাতে পর্যাপ্ত আমদানি থাকলেও বাজারে পণ্যটির দাম বাড়ছে। যোগাযোগ করা হলে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি এম হারুন উর রশিদ কালবেলাকে বলেন, ‘ভারত শুল্ক আরোপের পর প্রতি কেজিতে ভারতের দিক থেকে ৭ রুপি এবং বাংলা টাকায় ১০ টাকা খরচ যোগ হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি কেজি আমদানি পেঁয়াজ মানভেদে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পরে দাম কিছুটা বেড়ে ৫৮ থেকে ৬২ টাকা ওঠে। তবে বন্দর এলাকায় আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি মানভেদে ৫১ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি পর্যায়ে কোনো জটিলতা নেই।’

জানা গেছে, বন্দর থেকে ঢাকা বা অন্য মোকামে পৌঁছাতে প্রতি কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা পরিবহন খরচ পড়ে। এ হিসাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতি কেজি আমদানি পেঁয়াজের দাম ৫৪ থেকে ৫৯ টাকা হওয়ার কথা।

শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতির সভাপতি হাজি মো. সাঈদ কালবেলাকে বলেন, ‘পাইকারি আমদানি খরচ কিছুটা বেড়েছে। সে হিসেবে বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়েনি। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ এবং আমদানি পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬২ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরা কেন বেশি দামে বিক্রি করছেন, সেটি তারাই বলতে পারবেন।’

কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ালেও প্রশাসন তাদের কাছে যাচ্ছে না। সে কারণে বাড়তি দামে পণ্য কিনে খুচরা ব্যবসায়ীদের জরিমানায় পড়তে হচ্ছে। তাদের দাবি, বড় ব্যবসায়ীরা রসিদ ছাড়াই চুক্তিতে পণ্য বিক্রি করছেন।

অন্যদিকে, চাহিদার তুলনায় আলু বেশি উৎপাদন হলেও দাম বাড়ছে পণ্যটির। আগের লোকসান পুষিয়ে নিতে দাম কমানো হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন।

সরকারি ও খাত-সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, এ বছর চাহিদার তুলনায় বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে সাড়ে ১০ থেকে ১১ টাকা। ব্যাপারীদের কাছে কৃষক প্রতি কেজি আলু বিক্রি করেছেন ১৪ থেকে ১৫ টাকা দরে। ব্যাপারী বা বড় ব্যবসায়ীরা হিমাগার ভাড়া বা রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ প্রতি কেজিতে ৬ টাকা পর্যন্ত খরচ করছেন। সেই হিসাবে প্রতি কেজি আলুর মূল্য ২০ টাকা। যা হিমাগার থেকে ২৬ থেকে ২৭ টাকা খালাস করা সম্ভব এবং খুচরা পর্যায়ে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। আর এ বিবেচনায় সরকার প্রতি কেজি আলুর পাইকারি মূল্য ২৭ এবং খুচরা মূল্য ৩৬ টাকা বেঁধে দেয়। কিন্তু হিমাগারেই প্রতি কেজি আলু ৩৬ থেকে ৩৮ এবং পাইকারিতে ৪০ বা তারও বেশি এবং খুচরা পর্যায়ে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু কালবেলাকে বলেছেন, ‘টিসিবির মাধ্যমে উৎপাদনের উদ্বৃত্ত আলুর ন্যূনতম ১০ লাখ টন বাজারমূল্যে ক্রয় করে জেলা, উপজেলার হিমাগারে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। যা দাম বৃদ্ধির সময় সরবরাহ করলে আলুর দর স্বাভাবিক বা স্থিতিশীল থাকবে।’

সরকারের নির্ধারিত দামের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ কালবেলাকে বলেন, ‘সরকার আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম নির্ধারণের পর থেকে তা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ১৫ কোটি ডিম আমদানির কার্যক্রম চলমান। আমদানি ডিম বাজারে এলে হয়তো একটা চাপ তৈরি হতো। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে বছরের এ সময়ে ঘাটতি দেখা দেয়। যেজন্য আমদানির অনুমতি রয়েছে। সেক্ষেত্রে বাজার তদারকি চলমান। আলুর ক্ষেত্রে দাম নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে স্থানীয় সরবরাহ ব্যবস্থায় তদারকি করা হচ্ছে। সেখান থেকে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে যেভাবে আশা করা হচ্ছে, তেমনটা হচ্ছে না।’

অনেক ব্যবসায়ী নেতা ও বাজার বিশ্লেষক বলছেন, টিসিবি বা সরকারের সামাজিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নির্ধারিত দামে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ানো গেলে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব বলেন, প্রতি মাসে টিসিবির মাধ্যমে সরবরাহ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনের তুলনায় সেটিও কম। তবে সরকার চেষ্টা করছে আওতা বাড়ানোর জন্য। ইতোমধ্যে টিসিবির কার্যক্রমে সরবরাহ বাড়ানোর জন্য অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

নিত্যপণ্যের বাজার বিশ্লেষক কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে দাম বেঁধে দিলে সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার তেমন কোনো উন্নতি করতে পারেনি।’

তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন, ‘ধরুন, কোনো একজনকে বিমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হলো। কিন্তু তার কোনো টিকিট নেই। কিন্তু অফিসের নির্দেশে স্পষ্ট বলা আছে, তাকে বিমানে চট্টগ্রামে যেতে হবে। এখন কী হবে? আমাদের নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, যার টাকা আছে সে খাবে! যার টাকা নেই খাবে না! এ অবস্থায় ভোক্তাদের ভরসা সরকার। সরকার যদি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে, তাহলে ভোক্তারা ভালো থাকবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের অতিমাত্রায় বল প্রয়োগ করলে তারা সংশ্লিষ্ট পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দিতে পারে। এজন্য সব মহলের সমন্বয় ও সহনশীলতা থাকতে হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চাকসু নির্বাচনে নতুন প্রত্যয়ে ছাত্রদল

বন্দর ব্যবসায়ী নেতারা / মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধের ষড়যন্ত্রের অংশ

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি নিয়ে ৬ হাজারের বেশি মতামত পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়

জুলাইয়ের গাদ্দারদের সব রেকর্ড প্রকাশ করা হবে : মুনতাসির

যে ছয় ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছাড়তে রাজি নয় ইসরায়েল

ময়মনসিংহে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার

ধানের শীষের বিজয় মানেই জনগণের মুক্তি : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা

বাবর আজমকে নিয়ে ধারাভাষ্যে রমিজ রাজার তির্যক মন্তব্য

‘সঠিক ও মানসম্পন্ন সংবাদ উপস্থাপনে সাংবাদিকদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে’

১০

আন্দরকিল্লা মসজিদ আইকনিক করতে ব্যয় ৩০০ কোটি

১১

মেসির চেয়েও ধনী শুধু দুইজন ক্রীড়াবিদ!

১২

প্রবাসীর ছেলেকে দাদা-দাদির কবরের পাশে ঠাঁই দিল না চাচারা

১৩

শৈত্যপ্রবাহ নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

১৪

বিপিএলের জন্য নতুন রূপে প্রস্তুত হচ্ছে রাজশাহী স্টেডিয়াম

১৫

সাংবাদিককে আটক করে পুলিশের মারধর, গায়েব করার হুমকি

১৬

রেড ক্রিসেন্ট থেকে এনসিপি নেতাকে অব্যাহতি

১৭

নাসিরের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে আবারও এনসিএল শিরোপা রংপুরের ঘরে

১৮

কিশোরগঞ্জ থাকবে ঢাকাতেই, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ

১৯

মক্কায় ১২৫ কিমি এলাকাজুড়ে স্বর্ণের খনির সন্ধান 

২০
X