প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ শুরু হতো প্রতিবছরের জানুয়ারিতে। শিক্ষকদের এই প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। তবে চলতি বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসেও এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়নি। ফলে নতুন নিয়োগ পাওয়া ৩৭ হাজারসহ প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষক রয়ে গেছেন প্রশিক্ষণের বাইরে। এদিকে, সাড়ে পাঁচ মাস ধরে প্রশিক্ষণ বন্ধ থাকায় একদিকে শিক্ষকরা যেমন পিছিয়ে পড়ছেন, অন্যদিকে পিটিআইর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ না করেও মাসে মাসে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পিটিআইয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণেই এমন জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) ১ জুলাই থেকে ১৫টি পিটিআইয়ে এই কোর্স চালু করার জন্য তড়িঘড়ি করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। প্রশিক্ষণে অংশ নিতে রেজিস্ট্রেশন করা শিক্ষকদের ৩০ জুন সংশ্লিষ্ট পিটিআইয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে। তবে সেদিন পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটি রয়েছে।
পূর্বঘোষিত সরকারি ছুটির তালিকা অনুযায়ী, চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ২৮ থেকে ৩০ জুন ঈদুল আজহার ছুটি রয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি ২৭ জুন থেকে এই ছুটি শুরুর সুপারিশ করেছে। আর ৩০ জুনের (শুক্রবার) পরদিন ১ জুলাই (শনিবার) সাপ্তাহিক সরকারি ছুটি। আবার পিটিআইগুলোতে এবার গ্রীষ্মকালীন অবকাশ ও ঈদুল আজহার ছুটি চলবে ২১ জুন থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত। তাই ছুটির মধ্যে কোর্স শুরু করা নিয়েও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। একাধিক সূত্র বলছে, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ পিটিআইগুলোয় ১৮ মাসের ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) কোর্সকে সংকুচিত করে ১০ মাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই মূলত এ নিয়ে সংকট শুরু হয়, যা এখনো চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে ৫০ হাজার শিক্ষক প্রশিক্ষণবিহীন থাকা সত্ত্বেও এ বছর জানুয়ারি মাসে ৬৭ পিটিআইয়ে কোর্স শুরু না করে ১৫টি পিটিআইয়ে পাইলটিংয়ের সিদ্ধান্ত শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করেছে। তাদের মতে, জানুয়ারি মাস থেকে ৫২টি পিটিআইয়ে চলমান ডিপিএড কোর্স চালু রেখে ১৫টি পিটিআইয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণের পাইলটিং করা হলে প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের যে ব্যাকলক সৃষ্টি হয়েছে তা কিছুটা হলেও দূরীভূত হতো।
সংকটের শুরু যেভাবে : দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ আছে ৪ লাখ ২৭ হাজার ৯৭১টি। এখন কর্মরত আছেন ৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৫ জন শিক্ষক। তাদের মধ্যে সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া ৩৭ হাজার শিক্ষকও আছেন। তারাসহ প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষক বর্তমানে প্রশিক্ষণবিহীন বলে সূত্র জানিয়েছে।
এক সময় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কোর্স ছিল এক বছর মেয়াদি। তখন প্রশিক্ষণ কোর্সটির নাম ছিল সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন (সিইনএড)। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে এই কোর্সের মেয়াদ এক বছর থেকে বাড়িয়ে দেড় বছর (১৮ মাস) করার কথা বলা হয়। পরে শিক্ষানীতির সুপারিশ ও শিক্ষাক্রম-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ২০১২ সালে প্রথমে ৭টি বিভাগীয় শহরে অবস্থিত পিটিআইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ১৮ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়। গুরুত্ব বিবেচনায় কোর্সের নাম দেওয়া হয় ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড)। ২০১৯ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে দেশের সব পিটিআইয়ে ডিপিএড কোর্স শুরু হয়। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করে আসছে ময়মনসিংহে অবস্থিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)। এটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ডিপিএডসহ দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও পরিমার্জনের আইনগত এখতিয়ারভুক্ত প্রতিষ্ঠান।
সূত্র জানায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালককে (প্রশিক্ষণ) সদস্য সচিব করে ডিপিএড কোর্স পরিমার্জনের জন্য একটি ‘স্টিয়ারিং কমিটি’ এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালককে (প্রশিক্ষণ) আহ্বায়ক করে ‘ডিপিএড প্রশিক্ষণ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন কমিটি’ গঠন করা হয়। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে পিটিআইয়ের মাধ্যমে পরিচালিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সের সময় সংকুচিত করার চেষ্টা শুরু করেন প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা। গত বছরের নভেম্বরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পরিমার্জিত প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ শিক্ষাক্রম স্টিয়ারিং কমিটি’র এক সভায় প্রশিক্ষণের মেয়াদ ১৮ মাস থেকে কমিয়ে ১০ মাস করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ সংকুচিত মেয়াদের কোর্সের নতুন নাম দেয় মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ (বিপিটিটি)।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই কমিটি ১৫টি পিটিআইয়ে ১০ মাস মেয়াদি মৌলিক প্রশিক্ষণ পাইলটিং হিসেবে চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাকি ৫২টি পিটিআইয়ে এ সময়ে কী হবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। এদিকে, ১০ মাস মেয়াদের কোর্সের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন পিটিআইয়ের একজন ইনস্ট্রাক্টর। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর ছয় মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেন হাইকোর্ট। পরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় চেম্বার আদালতে যায়। গত ৭ মে চেম্বার আদালত হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় দুই মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে এ সময় শেষ হবে।
বিপিটিটি শুরুর তোড়জোড় : প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন এখন ১৫টি পিটিআইয়ে মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ বা বিপিটিটি কোর্স শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য চলছে তোড়জোড়। তাদের এই তৎপরতা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ১৮ মাসের বদলে ১০ মাসের এই কোর্স কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে পিটিআইয়ের ইনস্ট্রাক্টরদের মধ্যেই প্রশ্ন আছে।
এদিকে, নতুন কোর্সের নাম নিয়েও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। গত ১৮ মে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত একটি সভার কার্যবিবরণীতে নতুন কোর্সটির নাম পরিমার্জিত ডিপিএড হবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু গত ৭ জুন জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মৌলিক প্রশিক্ষণ নামে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। পিটিআই সূত্রগুলো বলছে, মূলত কিছুটা ‘এদিক-সেদিক’ করেই প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ তাদের নেওয়া আগের সিদ্ধান্তটি যে কোনোভাবে বাস্তবায়ন করতে চাইছে।
জানতে চাইলে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) মহাপরিচালক মো. শাহ আলম কালবেলাকে বলেন, এখন ১৫টি পিটিআইয়ে পাইলটিং হচ্ছে। আর বাকিগুলোতে ১ জানুয়ারি থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হবে।
৭ জুন নেপ এক আদেশে জানায়, প্রশিক্ষণার্থীদের (শিক্ষক) ভর্তি হওয়া পিটিআইয়ে ছয় মাস প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আর নিজ উপজেলার নির্ধারিত বিদ্যালয়ে চার মাসের ইন্টার্নশিপ করতে হবে। পিটিআইয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পূর্ণ আবাসিক। তাই কোনো প্রশিক্ষণার্থী এই সময় পিটিআইয়ের বাইরে অবস্থান করতে পারবেন না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করছি। আগে ১৫টি পিটিআইয়ে পাইলটিং হবে। সেটি শুরু হবে ১ জুলাই থেকে। আর সবগুলো পিটিআইয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হবে আগামী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে। নতুন পরিমার্জিত কারিকুলামের কারণে কিছুটা দেরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই কোর্স আগে ছিল ডিপিএড। তারও আগে সিএনএড। অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে পরিমার্জিত ডিপিএডে বলা হয়েছে, কারণ আমাদের ডোনার এজেন্সির সঙ্গে কর্মকাণ্ডে ‘ডিএলআই’ হিসেবে এটি বলা আছে। সেজন্য বিজ্ঞপ্তিতে এটি বলা হয়েছে। মূলত পরিমার্জিত ডিপিএডের নামই বিপিটিটি।
মন্তব্য করুন