মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৩৫ এএম
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্কুলে কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে না

পরিপত্র উপেক্ষিত
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দেশে কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে এখনো তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। স্কুলগুলোতে নেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার সুযোগ-সুবিধা। ঋতুস্রাব শুরু হলে কিশোরীদের বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। স্বাস্থ্যবিদরা ঋতুস্রাবের সময় প্রতি ৮ ঘণ্টা পরপর স্যানিটারি প্যাড পরিবর্তনের কথা বললেও স্কুল শিক্ষার্থীদের পক্ষে তা মেনে চলা সম্ভব হয় না। এ কারণে ঋতুস্রাবের সময় বেশিরভাগ কিশোরী স্কুলে অনুপস্থিত থাকে।

শরীয়তপুরের লাউখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া আক্তার জানায়, তাদের স্কুলের টয়লেট স্যাঁতসেঁতে। অন্ধকার টয়লেটে যেতে তার অস্বস্তি হয়। ঋতুস্রাব শুরু হলে সে তিন-চার দিন স্কুলে যায় না। রাজধানীর একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আনিকা তাবাচ্ছুম। ঋতুস্রাবের সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে সে-ও একই ধরনের কথা জানায়। তাবাচ্ছুম জানায়, স্কুলের টয়লেটের দরজা ভাঙা। এজন্য সে স্কুলের টয়লেট এড়িয়ে চলে। কিন্তু ঋতুস্রাবের সময় তাকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। শুধু সাদিয়া বা আনিকার স্কুল নয়, এই চিত্র দেশের প্রায় সব স্কুলের।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভেতে বলা হয়েছে, প্রতি ১১৫ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে স্কুলে টয়লেট আছে একটি। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ বন্ধ থাকে। ৪২ শতাংশে নেই পর্যাপ্ত পানি। সাবান কিংবা হ্যান্ডওয়াশ নেই ৬৮ শতাংশ টয়লেটে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ৩০ শতাংশ কিশোরী ঋতুস্রাবের সময় স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। একজন কিশোরী মাসে গড়ে অনুপস্থিত থাকে ২ দশমিক ৫ দিন। বেশিরভাগ স্কুলে মেয়েদের জন্য পৃথক এবং ব্যবহারের উপযোগী টয়লেট নেই বললেই চলে। এ কারণে অনুপস্থিতির হার কমানো সম্ভব হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, যথেষ্ট গোপনীয়তা এবং মেয়েদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উপযোগী টয়লেট নিশ্চিত করতে পারলে ছাত্রীদের স্কুলে অনুপস্থিতির হার কমানো সম্ভব। ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে স্কুলপড়ুয়া কিশোরীদের বড় একটি অংশ ইউরিন ইনফেকশনসহ নানা জটিলতায় ভুগছে। এ বিষয়গুলোতে স্কুল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দিতে হবে।

রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাড়ে ৯ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। সেখানে টয়লেট আছে ১০৮টি। প্রতিদিন গড়ে ৮৭ জন শিক্ষার্থী একটি টয়লেট ব্যবহার করছে। মালিবাগের সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থী রয়েছে ৭ হাজারের বেশি। প্রতিষ্ঠানটির ছয়টি ভবনে টয়লেট আছে মাত্র ৬৯টি। স্কুলটিতে প্রতিদিন গড়ে ১০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী একটি টয়লেট ব্যবহার করছে। কিশোরীদের জন্য নেই হাইজিন কর্নার। এমনকি টয়লেটগুলো সংকীর্ণ ও অপরিচ্ছন্ন। ফলে স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তনের সুযোগও নেই।

বাসাবোর মিস্টিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চার শতাধিক শিক্ষার্থী আর ৪০ শিক্ষকের জন্য টয়লেট আছে মাত্র ছয়টি। প্রতিদিন গড়ে ৬৬ শিক্ষার্থী একটি টয়লেট ব্যবহার করছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে শিক্ষার্থী ১১ হাজারের বেশি। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য টয়লেট রয়েছে মাত্র ১৩৯টি। একটি টয়লেট গড়ে ৮০ জন শিক্ষার্থী ব্যবহার করে।

দেশের জনগোষ্ঠীর এক-পঞ্চমাংশ ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী। জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর তথ্যমতে, দেশে ১ কোটি ৭১ লাখ ৬০ হাজার ১৭৫ জনই ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীর সংখ্যা ১ কোটি ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৬৮২ জন। বর্তমানে ৬৯১টি সরকারি এবং ১৯ হাজার ৬৬২টি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে ১ কোটি ২৮ হাজার ৫০৯ শিক্ষার্থী রয়েছে। তার মধ্যে ৫৪ লাখ ৮১ হাজার ৭৬২ কিশোরী। অথচ কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যজ্ঞান আদান-প্রদান, সেবা চাওয়ার কার্যক্রম তুলনামূলক কম। সরকার গত কয়েক বছরে বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। এ লক্ষ্যে ন্যাশনাল অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ স্ট্র্যাটেজি ২০১৭ থেকে ২০৩০ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে; কিন্তু বাস্তবায়ন খুবই কম।

পরিপত্র আছে বাস্তবায়ন নেই: কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করতে ২০১৫ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখা, প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ, ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা রাখা, টয়লেটে ঢাকনাযুক্ত প্লাস্টিকের পাত্র রাখা, ঋতুকালীন (মাসিক) বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য একজন শিক্ষিকাকে দায়িত্ব দেওয়া, স্যানিটারি ন্যাপকিন (প্রয়োজনে টাকার বিনিময়ে) রাখার কথা রয়েছে। এরপর আট বছর পার হতে চলল। কিন্তু অধিকাংশ স্কুলে এসবের বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে।

এ বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এমসিএইচ-সার্ভিসেস ইউনিটের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. মনজুর হোসেন কালবেলাকে বলেন, অনেক স্কুল ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। কিছু কিছু স্কুলে পৃথক টয়লেট থাকলেও নেই হাইজিন কর্নার। স্যানিটারি প্যাড ডিসপোজেরও সুযোগ থাকে না। এতে ছাত্রীরা অস্বস্তিতে ভোগে। এ বিষয়ে শিক্ষকদের সচেতন হতে হবে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বা ডিজঅ্যাবিলিটি সম্পন্ন শিক্ষার্থীবান্ধব টয়লেট স্থাপন করতে হবে।

স্ত্রী ও প্রসূতিরোগ চিকিৎসকদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা কালবেলাকে বলেন, ঋতুস্রাব ব্যবস্থাপনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় কিশোরীদের স্যানিটারি প্যাড এবং তা ডিসপোজের প্রয়োজন হয়। ওয়াশিং ফ্যাসিলিটিসের প্রয়োজন। ঋতুস্রাবের সময় ওয়াটার স্যানিটেশন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়কে গুরুত্ব না দিলে কিশোরীদের বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রজনন গ্রন্থি, টিউব এবং জরায়ুতে ইনফেকশন হলে ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্বের আশঙ্কা থাকে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজামুখী সুমুদ ফ্লোটিলা আটক, জমিয়তের তীব্র নিন্দা

রাজধানীতে বৈষম্যবিরোধী কওমি ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ

পাচারকালে নারী-শিশুসহ ৩৮ জন উদ্ধার

ভূমিকম্পে কাঁপল ইরানের পারমাণবিক শহর

টানা পাঁচ দিন বজ্রসহ ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস

হিন্দুরা কোনো দলের সম্পত্তি নয় : মোশাররফ

আবরার ফাহাদের কবর জিয়ারত ডাকসু নেতাদের 

একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ২৬৩ 

৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া নবজাতক উদ্ধার

‘মানচিত্র থেকে মুছে দেব’, হুমকি ভারতীয় সেনাপ্রধানের

১০

এক ম্যাচেই তিনটি পেনাল্টি রুখে ইতিহাস গড়লেন তুর্কি গোলকিপার

১১

স্মার্টফোনের চার্জিং পোর্টের পাশে এই ছোট্ট ছিদ্র কেন থাকে? আসল রহস্য জেনে নিন

১২

শিশু তায়েবা হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন

১৩

পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান ধ্বংস নিয়ে ভারতের নতুন দাবি

১৪

কেন এআই চ্যাটবট মাঝেমধ্যে ভুল উত্তর দেয়? জেনে নিন আসল রহস্য

১৫

ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা / ‘যে প্রণোদনা দেওয়া হয় তাতে আমাদের কিছু হয় না’

১৬

জ্বরে ভুগছেন টাইগার ক্রিকেটার, দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে খেলা নিয়ে শঙ্কা

১৭

সন্ধ্যার মধ্যে ১০ জেলায় ঝড়-বৃষ্টির আভাস

১৮

স্লোগান দেওয়া সেই তরুণীর পক্ষে লড়তে চান ফজলুর রহমান

১৯

প্রাথমিক অবস্থায় যে ৫ লক্ষণ দেখলে বুঝবেন গলার ক্যানসারে ভুগছেন

২০
X