চট্টগ্রাম নগরে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে গ্যাস সরবরাহ। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে লাইনে গ্যাস না পাওয়ায় বাড়ি, রেস্তোরাঁয় রান্না হয়নি খাবার। ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন নগরের লক্ষাধিক মানুষ। বৈদ্যুতিক চুলা ও লাকড়ি জ্বালিয়ে যেসব রেস্তোরাঁ রান্নার কাজ সেরেছে, সেখানে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন, মুহূর্তে শেষ হয়ে গেছে সব খাবার। গ্রাহকদের অভিযোগ, গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আগে থেকে কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেনি। ফলে প্রস্তুতি না থাকায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তাদের।
এদিকে হঠাৎ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নগরের ফিলিং স্টেশনগুলোতেও গ্যাস মিলছে না। এ কারণে সড়কে কমে গেছে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চলাচল। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এ নিয়ে ভোগান্তি ছিল তুলনামূলক কম। মুরাদপুরের
অটোরিকশাচালক মুরাদ পারভেজ বলেন, ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে গ্যাস নিয়েছিলাম। আজ (শুক্রবার) দুপুর পর্যন্ত চলবে।’
গতকাল দুপুরে নগরের দুই নম্বর গেট এলাকায় সুলতান ডাইন, সেভেন ডেইস, হাজী কাচ্চিঘরসহ কয়েকটি রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে লাকড়ি দিয়ে কোনোমতে রান্না চলছে। ক্রেতাও খুব একটা নেই। নগরের ওয়াসার কুটুমবাড়িসহ বিভিন্ন রেস্তোরাঁরও একই অবস্থা। শুধু এসব এলাকাই নয়, চকবাজার, আগ্রাবাদ, হালিশহর, পতেঙ্গাসহ নগরের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় ক্রেতা দেখা গেছে কম। রান্না হয়নি অনেক রেস্তোরাঁয়।
মুরাদপুরের মক্কা হোটেলের কর্মচারী কামাল আহম্মেদ বলেন, ‘প্রতি শুক্রবার আমাদের রেস্টুরেন্টে মানুষের প্রচুর ভিড় থাকে। কিন্তু আজ সকাল থেকে গ্যাস না থাকায় ক্রেতা এলেও দেওয়া যায়নি খাবার।’
হোটেল মালিক সমিতির নেতা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘অনেকদিন ধরেই গ্যাস সংকট চলছে, যে কারণে কমে গেছে ব্যবসা। আমরা লাকড়ির চুলা ব্যবহার করছি। তারপরও পূরণ করা যাচ্ছে না ক্রেতাদের চাহিদা। ফলে অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন না খেয়ে। আশা করছি কর্তৃপক্ষ জোরালো পদক্ষেপ নেবে।’
নগরের আন্দরকিল্লা, লাভলেন, কাজীর দেউরি, আসকার দিঘীরপাড়, হিলভিউ, এনায়েতবাজার, ওয়াসা, দুই নম্বর গেট, হামজারবাগ, মুরাদপুর, রৌফাবাদসহ বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকরা বলেছেন, হোটেলে গিয়েও খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে তাদের কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে মাটির চুলা ব্যবহার করছেন। কেউ সিলিন্ডার কিনেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আদনান মান্নান থাকেন নগরের কাতালগঞ্জ এলাকায়। তিনি জানান, গ্যাস না থাকায় তার বাড়িতে চুলা জ্বলেনি। নগরের আতরের ডিপো এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাসায় গ্যাস না থাকায় সকালে নাশতা করতে দোকানে গিয়েছিলাম; কিন্তু দোকানেও কোনো নাশতা তৈরি হয়নি। না খেয়ে আছি।’
বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা সালমা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তিন মাস ধরে গ্যাসের তীব্র সংকট। এসব যেন দেখার কেউ নেই।’
অন্যদিকে গ্যাসের এই সংকটের প্রভাব পড়েছে বিয়েবাড়িতেও। নগরের বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের রান্না হয়েছে লাকড়ির চুলায়। এতে লেগেছে অনেক সময়। নগরের চন্দনপুরার এক কমিউনিটি সেন্টারে গতকাল সাতকানিয়ার সোহাগ আহম্মেদের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আন্দরকিল্লার সাজেদা চৌধুরীর; কিন্তু তাদের বিয়ের খাবারের আয়োজন শেষ করতেই সময় গড়িয়েছে বিকেল পর্যন্ত। এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা গেছে দুই পক্ষেই। বিয়ের রান্নার কারিগর কাদের হোসেন বলেন, ‘গ্যাস না থাকায় আমাদের কাজে (রান্না) দেরি হয়েছে।’
সারা শহরের গ্যাস সংকটের বিষয়টি নিশ্চিত করে কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান কালবেলাকে বলেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয়। আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। এর মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি গত ১ নভেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে। এটি বৃহস্পতিবার চালু হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু চালু করা যায়নি। এ ছাড়া পেছনের গতি বা ব্যাক প্রেশার না থাকার কারণে সামিট এলএনজি টার্মিনালটিও গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না। এ কারণে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
আমিনুর রহমান আরও বলেন, ‘আজ (গতকাল) সারাদিন গ্যাস না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ সামিটের টার্মিনালটি খালি করা হচ্ছিল। এটিও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে যাওয়ার কথা আছে।’ গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির বিপণন উত্তর বিভাগের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী গৌতম চন্দ্র কুণ্ডু বিকেল সাড়ে ৪টায় কালবেলাকে বলেন, ‘কিছুক্ষণ আগে পেট্রোবাংলাসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে মিটিং শেষ করলাম। আশা করি আগামীকাল (আজ) গ্যাস সরবরাহ চালু হবে।’
চট্টগ্রামে কেজিডিসিএলের গ্রাহক সংযোগ ৬ লাখ ১ হাজার ৯১৪টি। এর মধ্যে গৃহস্থালি সংযোগ ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১টি। বাকিগুলো
শিল্প-বাণিজ্যসহ অন্য খাতে। এসব খাতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল থেকে পাওয়া যায় ২৮০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ১ নভেম্বর থেকে কমবেশি ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম পাওয়া যাচ্ছিল। এ কারণে সব ধরনের গ্রাহকই বিপাকে পড়েন।
কেজিডিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কিন টার্মিনালটি চালু হলেও সংকট যাবে না। কারণ, সামিটের টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণে যাবে। দুটি সমানতালে চালু থাকলেই গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ আছে। দুটি টার্মিনাল মিলে দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো। এ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়।