৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘ডামি’ ও ‘নব্য প্রতারণা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। গতকাল শনিবার কালবেলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে জাতির সামনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে গেছে। নগণ্যসংখ্যক ভোটার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে, তাদের কোনো জনসমর্থন নেই। সব মিলিয়ে ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ দল হিসেবে ‘সুইসাইড’ করেছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট বর্জনের আন্দোলনে বিএনপি সফল হয়েছে দাবি করে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, দলে নেতৃত্বের কোনো সংকট নেই। সবাই তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।
এ ছাড়া বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা, সরকারবিরোধী আন্দোলনসহ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। নিচে তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
কালবেলা: দেশের বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করুন?
মাহবুব উদ্দিন খোকন: গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড করা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনের দরজায় আঘাত করা, পুলিশ হত্যা করা বা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দেওয়া সবকিছুই ছিল একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। পুলিশের অনুমতির পরই কিন্তু বিএনপি মহাসমাবেশের আয়োজন করেছিল। হঠাৎ করেই সেদিন প্রধান বিচারপতির বাসভবনের দরজায় আঘাতের খবর ছড়াল। এখন তো প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, প্রধান বিচারপতির বাসভবন, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তো সরকারের। কিন্তু সেদিন তারা নিরাপত্তা দেয়নি কেন? এমনকি যেই মহাসমাবেশের অনুমতি সরকার দিয়েছে, সেখানেও নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। তারা নিরাপত্তা দেয়নি। বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করার জন্য সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ওই ঘটনা ঘটিয়েছে।
এর পরই দেশবাসী দেখেছে যে, পুলিশ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। মহাসমাবেশ ঘিরে ঢাকাসহ সারা দেশে সাত হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। লক্ষাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নতুনভাবে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। বাসাবাড়িতে পুলিশ হামলা ও হয়রানি করেছে। এসবের সূত্রপাত কিন্তু ২৮ অক্টোবর ঘিরেই, যা এখনো অব্যাহত রেখেছে। তারা তো পরে স্বীকারই করল যে, ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার না করলে আন্দোলন দমানো যেত না এবং নির্বাচন করা যেত না। সদ্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক স্বীকার করেছেন। এখানে তো তাদের উদ্দেশ্য স্বীকৃত।
আজ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার কিন্তু উন্নতি হয়নি। বেশিরভাগ মানুষ ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সরকার তো বলে যে, তারা দুই কোটি মানুষকে কার্ড দিয়েছে। গরিব মানুষ আছে বলেই তারা কার্ড দিয়েছে। কার্ডের মাধ্যমে দেওয়া চাল দিয়ে তো মানুষ চলতে পারে না। এত গরিব মানুষ থাকলে এই সরকারের অর্জনটা কোথায়? দেশের সম্পদ আওয়ামী লীগের লোকদের কাছে চলে গেছে। অন্যদিকে মানুষের দারিদ্র্য বাড়ছে। দেশে শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ নেই। উচ্চশিক্ষিত, আধা শিক্ষিত কারও চাকরি নেই। বেকারত্ব বাড়ছে। এই বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কারণে দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এমনকি দেশ পরিচালনায়ও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সেজন্য তাদের চলে যাওয়ার এখনই সময়। আমি মনে করি, এই সরকারের এ মুহূর্তে পদত্যাগ করা উচিত।
কালবেলা: ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কীভাবে দেখছেন?
খোকন: আওয়ামী লীগের কোনো জনসমর্থন নেই। তারা প্রতারণা করে ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৮ সালে আঁতাত করে ক্ষমতায় এসেছে। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতেই ডাকাতি করে ক্ষমতায় এসেছে। এবার নব্য প্রতারণার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। তারা স্বতন্ত্র ও ডামি প্রার্থী দিয়ে নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া লাগিয়েছে। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে এখন শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ দল হিসেবে ৭ জানুয়ারি ‘সুইসাইড’ করেছে। আওয়ামী লীগের বিভক্তি কিন্তু দীর্ঘদিন চলবে এবং দলটি আরও দুর্বল হবে। এমনকি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে কত দুর্বল হয়ে গেছে সেটা কিন্তু জাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। কারণ আওয়ামী লীগ দাবি করে তাদের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট রয়েছে। এখন তো আওয়ামী লীগের ভোটও নেই। এখন ৩ থেকে ৫ শতাংশে নেমেছে আওয়ামী লীগের ভোট। তাদের জনসমর্থন কত দুর্বল! এ ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দৈন্য প্রমাণিত হলো।
কালবেলা: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন আন্দোলনে কতটুকু সফল বিএনপি?
খোকন: বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো বারবার করে জনগণকে আহ্বান জানিয়েছে নির্বাচন বর্জনের। সুতরাং ৭ জানুয়ারি দেশের জনগণ নির্বাচন বর্জন করেছে। কারও কারও ভাষ্য যে, ২ বা ৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। এক কথায়, গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দেশের জনগণ বর্জন ও প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বিএনপিসহ বিরোধী দলের দাবির প্রতি সমর্থন ও সহমর্মিতা জানিয়েছে। আমরা বহুবার বলেছি, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দ্বারা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তবুও সরকারের নির্দেশেই ইসি নির্বাচন করেছে। যেভাবে ভোট হয়েছে তাতে প্রমাণিত হলো, এই ইসি কিন্তু কোনো অনিয়মই চোখে দেখেনি। অথচ একতরফা ও ডামি নির্বাচনেও ভোট চুরি হয়েছে। অন্যায় ও কারচুপি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এখনো খবর আসছে। কিন্তু তারা সেগুলো দেখেনি। তারা অন্ধ ছিল। অন্ধত্বের প্রমাণ দিয়েছে ইসি। তারা কানেও শোনে না।
কালবেলা: বিএনপি এখন কী করছে?
খোকন: আমাদের যে একদফার আন্দোলন, তা চলছেই। এই দাবিতে আমাদের কর্মসূচি এখনো অব্যাহত রয়েছে। আমরা সফলতা দেখছি। সেইসঙ্গে দেশের জনগণ আওয়ামী লীগের দৈন্যদশাও দেখছে। দেশ পরিচালনায় সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণিত হলো। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেক বেশি। পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় রাজধানী ঢাকা—এমনকি অনেক শহরে জিনিসপত্র খুবই ব্যয়বহুল। কারণ কী? সরকারের ব্যর্থতার জন্য। দেশের রিজার্ভ নেই, গার্মেন্ট খাতে দুরবস্থা, গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না। রপ্তানি করতে পারছে না। আওয়ামী লীগ তাদের নেতাদের নামে-বেনামে ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে। এরপর তারাই কিন্তু ব্যাংকের সব টাকা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। ঋণ করে করে তারা ব্যাংকের রিজার্ভ বেশি দেখাচ্ছে। এটা তো কোনো বাহাদুরি হলো না।
কালবেলা: বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী এখন কারাবন্দি, তাদের মুক্তির জন্য কি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?
খোকন: আওয়ামী লীগের নেতা ড. আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে জেলে রাখা হয়েছে। তার কথায় প্রমাণ হয়েছে, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ প্রায় দুই হাজার লোককে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নিম্ন আদালতে অনেক নেতাকর্মীকে মিথ্যা সাজা দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের আটক রাখা হয়েছে। তবুও আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আইনজীবীরা কাজ করছেন।
কালবেলা: বিএনপির পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচি কী হবে?
খোকন: একদফা দাবিতে যে আন্দোলন চলছে, তা জনগণ অব্যাহত রাখবে। যে পর্যন্ত এই সরকার পদত্যাগ না করবে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা পদত্যাগ না করবেন, ভোটাধিকার নিশ্চিত না হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না আসবে কিংবা নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে ফয়সালা না হবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। কেননা এটা তো বিএনপির একার আন্দোলন নয়। বিএনপি ক্ষমতায় বসার জন্য আন্দোলন নয়। জনগণকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য আন্দোলন। দেশ কে চালাবে? দেশ কীভাবে চলবে? এসবের ম্যান্ডেট কিন্তু জনগণই দেবে।
বিএনপি হচ্ছে কর্মী ও সমর্থকভিত্তিক রাজনৈতিক দল। ধাপে ধাপে কিন্তু সবাই অভিজ্ঞ। মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য হাজার হাজার, লাখ লাখ নেতাকর্মী সৃষ্টি হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ও মাঠের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেই কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। আমি মনে করি, বিএনপি তারেক রহমানের নেতৃত্বে এক এবং ঐক্যবদ্ধ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেক ষড়যন্ত্র ও চেষ্টা করেও কিন্তু এই দলকে কিছু করতে পারেনি। তারা বিএনপি নেতাদের এমপি-মন্ত্রী বানানোর লোভ দেখিয়েছিল।
কালবেলা: বিএনপিতে নতুন নেতৃত্ব বিকাশে কী করণীয় বলে মনে করেন?
খোকন: চলমান আন্দোলনে বিএনপির নেতাকর্মীদের একটা বড় পরীক্ষা কিন্তু হয়ে গেল। অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। যারা সত্যিকার অর্থে বিএনপি করেন, হয়তো কোনো কারণে সামনে আসেননি। যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের জায়গায় নতুন নেতৃত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে এসেছে। সুতরাং এই আন্দোলনে নেতাকর্মীদের জন্য একটা পরীক্ষা হয়ে গেছে, কারা নেতৃত্ব দিতে পারবেন? নিশ্চয়ই দলের হাইকমান্ড যোগ্যদেরই নেতৃত্বে আনবেন।